মুক্ত তারুণ্যের গান

August 9, 2018

ভালো কাজের অভাব, শ্রম অধিকার চর্চার সীমিত সুযোগ এবং সামাজিক সেবা নিতে বাড়তি ব্যয় একজন তরুণের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সামর্থ্যকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ধরনের পরিস্থিতি বৃহৎ পরিসরে উন্নয়ন ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ব্র্যাক একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এর নাম ‘আরবান ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ’। কী করলে ঢাকা শহরের দৈনন্দিন জীবনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা যাবে, তেমন আইডিয়া জমা দিতে বলা হলো। তরুণ স্থপতি ফারহানা রশীদের প্রতিষ্ঠান ‘ভূমিজ’ নারীদের ব্যবহারের উপযোগী টয়লেট তৈরি ও তার রক্ষণাবেক্ষণের একটি চমকপ্রদ আইডিয়া জমা দিল। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ফারহানা ব্র্যাকের অর্থায়নে শহরের ব্যস্ততম মার্কেট গাউসিয়ায় একটি আধুনিক টয়লেট তৈরি করল। এটা গত বছরের অক্টোবর মাসের কথা।

আমাদের ঢাকা শহরের পাবলিক টয়লেটগুলোর অবস্থা বেশ শোচনীয়। একদিকে সময়ের প্রয়োজনে নারীদের দীর্ঘক্ষণ রাস্তাঘাটে থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েদের জন্য ব্যবহার উপযোগী পাবলিক টয়লেটের অভাব। টয়লেট ব্যবহার করতে না পারায় নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

এইসব চিন্তা থেকেই ফারহানা গাউছিয়াসংলগ্ন নূর ম্যানশনের একটি টয়লেটকে নারীদের জন্য উপযোগী করে তুলতে চাইল। সেইসঙ্গে ফারহানা এমন একটি মডেল তৈরি করল যার মাধ্যমে স্থানীয়ভাবেই টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণের খরচ উঠে আসবে। এ ধরনের কাজের কথা নানা সময় হয়তো অনেকেই ভেবেছেন, কিন্তু করে দেখাল ফারহানা। ভিন্নধারার ভাবনার এই ব্যাপারগুলোই ফারহানাদের মতো তরুণদের অন্যদের চাইতে আলাদা করে দেয়। এরকম আরও অসংখ্য তরুণের ভিন্নধারার ভাবনাগুলোকে বাস্তব রূপদানের মাধ্যমেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সি যুবসম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় ১.৮ বিলিয়ন। আমাদের দেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সিদের তরুণ হিসেবে ধরা হয়। বয়সসীমা যা-ই হোক না কেন তরুণ মানেই হলো বাধা না-মানা, এগিয়ে যাওয়া। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি নির্ভর যে উন্নত বিশ্ব আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা এসেছে তরুণদের হাত ধরেই।

এবার চোখ রাখি নিজের দেশের দিকে। বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দেশ। এদেশের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশই তরুণ। মধ্যম  আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সমাজ ও প্রেক্ষাপট। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে বিরাজমান সমস্যাগুলোকে  প্রযুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে সমাধানের মাধ্যমে তরুণরাই হয়ে উঠছে এগিয়ে যাওয়ার মূল চালিকা শক্তি।

উল্টোপিঠের চিত্রও আছে। জাতিসংঘের হিসাব মতে যুবসম্প্রদায়ের প্রতি ১০ জনের ১ জন বাস করে সংঘাতময় অঞ্চলে এবং বিশ্বব্যাপী স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুদের সংখ্যা ২৪ মিলিয়ন। আমাদের দেশেরও এটি একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-র তথ্যানুযায়ী প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ২০ শতাংশ ঝরে পড়ে। মাধ্যমিক স্তরে ৪০ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়  ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া ছেড়ে দেয়।

এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী দক্ষ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা অদক্ষ জনবলে পরিণত হয়। আবার আজকের তরুণদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে তা-ও ভিন্ন ধারার। বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ এবং রাজনীতি ও নাগরিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণে অনাগ্রহী হয়ে তারা সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পরিবার, বন্ধু ও সমাজ বিছিন্ন তরুণদের মধ্যে এক ধরনের আত্মসংকট তৈরি হচ্ছে। এজন্যই কখনও কখনও তরুণদের জীবন একধরনের অনিরাপদ অবস্থানের দিকে চলে যাচ্ছে।

১২ই আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস। জাতিসংঘ এবারের যুব দিবসের শ্লোগান নির্ধারন করেছে ‘সেফ স্পেস ফর ইয়ুথ’। ‘সেফ স্পেস’-এর আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘নিরাপদ জায়গা’। আর এই যুব দিবসে ‘ডিজিটাল, পলিসি, সিভিল, ফিজিক্যাল’- এই ৪টি ক্ষেত্র তরুণদের জন্য নিরাপদ রাখার বিষয়টি তুলে ধরার লক্ষ্যে এই শ্লোগান বেছে নেয়া হয়েছে।

পরিবর্তনের কান্ডারি এই তরুণদের জন্য প্রয়োজন একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম। যেখানে তারা একত্রিত হতে পারবে, চাহিদা ও পছন্দমাফিক বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে এবং নিঃসঙ্কোচে নিজেদের তুলে ধরতে পারবে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করা বিভাগ ইউএন ডেসা (ইউনাইটেড ন্যাশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ধরনের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে তরুণরা বসবাস করে, সেটার ওপর নির্ভর করে ওই পরিবেশে তারা কতটুকু যুক্ত হচ্ছে বা মানিয়ে নিচ্ছে।

অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারার মতো বিষয়গুলো দীর্ঘমেয়াদে একজন তরুণকে ব্যক্তিগতভাবে ও সমাজকে লাভবান করতে পারে। অন্যদিকে ভালো কাজের অভাব, শ্রম অধিকার চর্চার সীমিত সুযোগ এবং সামাজিক সেবা নিতে বাড়তি ব্যয় একজন তরুণের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সামর্থ্যকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ধরনের পরিস্থিতি বৃহৎ পরিসরে উন্নয়ন ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। তরুণরা রাজনীতিতে অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়ছে কী?  অস্বস্তি আছে দেশের সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও। মূলত এসবই তরুণদের নানাবিধ সামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধাগ্রস্ত করছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ বিশেষত সবার জন্য নিরাপদ, স্থিতিশীল ও টেকসই নগর গড়ে তোলার লক্ষ্যে তরুণদের উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিতে শুধু অর্থায়ন করলেই হবে না, সেইসঙ্গে মেন্টরিং, আইনি সহায়তা, প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার, গবেষণা ইত্যাদির দিকেও নজর দিতে হবে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের কারিগরি শিক্ষাও দরকার। বাড়াতে হবে মানবিক গুণাবলির চর্চা। পৃথিবীর যে প্রান্তেরই বাসিন্দা হোন-না কেন ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে আজ আমরা সহজেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারি। সুতরাং সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য করা যেতে পারে আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সুশাসন নিশ্চিত করে দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ইস্যুগুলোতে তরুণদের আগ্রহী করে তুলতে পারি। তাদের খেলাধুলার জন্য তৈরি হোক নিরাপদ খেলার মাঠ। তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। সুতরাং বলা যেতে পারে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম তৈরি হোক। তরুণরা হয়তো তা দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারবে।

সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের পথে আমাদের যাত্রার অগ্রভাগে তরুণদের অবস্থান। তারা রচনা করছে গান, তারা অর্থনীতিতে রাখছে অবদান। তারুণ্য অমর হোক, নিরাপদ হোক, প্রাণবন্ত হোক।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments