বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে থাকা এক নির্ভীক যোদ্ধা

April 5, 2018

মা ব্র্যাকের একজন গ্রাম সংগঠক হবার সুবাদে ব্র্যাকের কার্যক্রম সম্পর্কে সুফিয়া জানতেন। কলেজ শেষ করে ১৯৯৭ সালে তিনি শিক্ষিকা হিসেবে ব্র্যাক স্কুলে যোগদান করেন এবং ২০০২ সালে তিনি প্রোগ্রাম সেক্রেটারি পদ লাভ করেন। তাঁর ভাষায়, “কাজটা একদমই সহজ ছিল না”।

“কত বছর হলে মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবে?”

“১৮!” সমস্বরে সবাই জবাব দেন।

“১৮ বছরের একদিন কম হলেও বিয়ে দেয়া হলে সেই বিয়েকে কি বলা হবে?”

“বাল্যবিয়ে” সকলে আবার একসাথে বলে ওঠেন।

“আমরা কি বাল্যবিয়ে দিব?”

“না”

“সবাই আমরা বলি, বাল্যবিয়ে দিব না। বলেন..” সুফিয়া বেগম তার সামনে বসা সকলের উদ্দেশ্যে বলে চলেন।

মানবাধিকার এবং আইন সহায়তা কর্মসূচির একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে সুফিয়া কর্মরত আছেন নীলফামারি জেলায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজেকেই এর শিকার হতে হয়েছে, তাই বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট। তিনি খুশি যে বাল্যবিয়ে থামাতে এখন নানা ধরণের সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি এটা জানাতে ভোলেন না যে এখনও দেশের প্রতি তিনজন নারীর দুইজন বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। “এটা একেবারেই মেনে নেয়া যায় না”, তিনি বলেন, “লড়াই এখনও অনেক বাকি।”

নিজের ভাই ব্র্যাকের একটি স্কুলে পড়ত, সেখানে তাকে নামাতে যাবার সূত্র ধরেই ব্র্যাকের সাথে সুফিয়ার প্রথম পরিচয়। সুফিয়ার বাবা তাঁকে একটি স্থানীয় মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেখানকার থেকে ভাইয়ের স্কুলের প্রতিই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। লুকিয়ে লুকিয়ে সেই স্কুলের বোর্ড থেকে তিনি পড়া টুকে নিতেন, তারপর বাসায় গিয়ে সেগুলো শিখতেন। এমনটা খেয়াল করে সেই ক্লাসের শিক্ষিকা একদিন সুফিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁর বাবা-মাকে বুঝিয়ে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে রাজি করিয়ে ফেলেন।

মা ব্র্যাকের একজন গ্রাম সংগঠক হবার সুবাদে ব্র্যাকের কার্যক্রম সম্পর্কে সুফিয়া জানতেন। কলেজ শেষ করে ১৯৯৭ সালে তিনি শিক্ষিকা হিসেবে ব্র্যাক স্কুলে যোগদান করেন এবং ২০০২ সালে তিনি প্রোগ্রাম সেক্রেটারি পদ লাভ করেন। তাঁর ভাষায়, “কাজটা একদমই সহজ ছিল না”।

নিজের শ্বশুরবাড়িতে ১০ মাস বয়সী শিশুকে রেখে সুফিয়ার কাজে যেতে হত যারা ছিলেন তাঁর চাকুরি করার বিরুদ্ধে। সুফিয়ার স্বামী জন্ম থেকেই একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী এবং তিনি কোন কাজ করতেন না। সুফিয়া জানতেন পরিবারের দেখভাল করতে হলে তাঁর চাকুরি ছেড়ে দিলে চলবে না। কিন্তু শেষমেষ তিনি চাপের মুখে চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হন, আর এভাবে কেটে যায় পাঁচটি বছর।

এই সময়টা সুফিয়া তাঁর স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি আরও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। পাঁচ বছর সময় লাগলেও তিনি অবশেষে মাস্টার্স পাশ করেন। তারপর নতুন করে আবার যোগ দেন কাজে। এবার নীলফামারিতে ব্র্যাকের আইন সহায়তা কর্মসূচিতে। অনেকগুলো বছর এর মধ্যে কেটে গেছে। সুফিয়ার বড় ছেলে আজ একাদশ শ্রেণীর ছাত্র এবং ছোট মেয়েটির বয়স চার, সে ব্র্যাক স্কুলে পড়াশোনা করছে।

সুফিয়ার মনে পড়ে শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে তিনি তাঁর এলাকার মানুষকে বাল্যবিয়ের কুপ্রভাব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়াটাকে নিজের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে নেন। দেশের কত মানুষ যে এখনও বাল্যবিয়ের খারাপ দিকগুলো নিয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ, এমনকি অনেকেই যে জানেনই না বাল্যবিয়ে অবৈধ সে বিষয়েও তিনি দুঃখের সাথে কথা বলতে থাকেন। এই জায়গাগুলোতেই সুফিয়া নিজের উদ্যোগে বিভিন্ন ক্যামপেইন চালাতে চান কারণ অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এখানে মেয়েদের ওপর বাল্যবিয়ের অভিশাপ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বেশি।

নীলফামারির আইন সহায়তা বিভাগে সুফিয়ার অধীনে ছয়টি আইন ও সালিশ কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে থাকে যেখানে ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাস এবং নারী ও শিশুদের সাথে সংঘটিত যে কোন ধরণের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি সেবা ও সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। সুফিয়া এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন কর্মীবাহিনী এলাকার মানুষদের মধ্যে বাল্যবিয়ে এবং সকল প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বিভিন্ন বৈঠক নিয়মিত আয়োজন করে থাকেন।

সুফিয়া দৃঢ়কন্ঠে বলেন, “এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি সহায়তা যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।” প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে ব্র্যাকের আইনি সেবা ছাড়া সহায়তার আর কোন অবলম্বন নেই। সুফিয়ার মতে কাউন্সিলিং বৈঠকগুলো এক সাথে দুই ধরণের উদ্দেশ্য পূরণ করে। “এখানে শুধু বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কেই শেখানো হয় না, অনেকের কাছে এটি কথা বলারও জায়গা- এখানে প্রত্যেকেই কাউকে না কাউকে পাবেন যে বুঝতে পারে সে কি ধরণের যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন।”

সুফিয়া আজ পর্যন্ত তাঁর সংগঠিত বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কাজ যেমন অগণিত র‍্যালি, মানববন্ধন ইত্যাদি নিয়ে গর্ববোধ করেন। তাঁর মতে, “এই কর্মসূচিগুলো ছাড়া বহু মানুষের কথা বহুকাল ধরে চাপা পড়ে থাকত।”

সুফিয়া তাঁর সকল শক্তি, সকল অর্জন সবকিছুর জন্য ব্র্যাককেই আলোর দিশারী হিসেবে মানেন। দুই সন্তানের জননী সুফিয়া মনে করেন ব্র্যাকের কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে একজন নারী হিসেবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কঠোর চোখ এড়িয়ে একটি স্বাধীন জীবন যাপন করার; সামাজিক এবং ব্যক্তিজীবনে বিভিন্ন অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ সরকারের পক্ষ থেকে যে ‘জয়িতা’ পুরষ্কার তিনি অর্জন করেছেন তাঁর নেপথ্য কারণ হিসেবে তিনি সর্বদা ব্র্যাকের কথাই বলে থাকেন।

সুফিয়া এমন এক সমাজে সাম্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়তার সাথে লড়ে চলেছেন যেখানে নারীদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেয়া হয় না। তিনি নির্যাতন এবং বৈষম্যহীন একটি সমাজে নিজেকে দেখতে চান। “এমন এক পৃথিবী নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত চলবে আমার লড়াই, প্রয়োজন হলে আমরণ।”

4.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
জয়শ্রী সরকার

Salute sister. Great work.