রান্না ব্যাপারটাই এমন যে, যিনি রাঁধছেন এবং যারা খাচ্ছেন, তাদের মধ্যে নিজের অজান্তেই একধরনের সেতুবন্ধন তৈরি হয়ে যায়। খুব ভালো লাগত যখন আমার রান্না করা খাবার খেয়ে অফিসের কর্মকর্তারা বলতেন, “আপা, আপনার রান্না খেয়ে মনে হচ্ছে মায়ের রান্না/দাদির রান্না খাচ্ছি।”
সংসার জীবনের একপর্যায়ে দেখা যায় ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে নিজেদের জগৎ তৈরি করে নেয়, পরিবারের অন্যরাও নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন বাড়িতে থাকা মায়েদের ব্যস্ততা হঠাৎ করেই কমে যায়, সময় কাটানোই একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমি এ বিষয়টা নিয়ে প্রায়ই ভাবতাম। এ কারণে ক্যাটারিং ব্যবসার সুযোগটা যখন এলো তখন খুব গুরুত্ব দিয়েই কাজটা শুরু করলাম।
রান্না ব্যাপারটাই এমন যে, যিনি রাঁধছেন এবং যারা খাচ্ছেন, তাদের মধ্যে নিজের অজান্তেই একধরনের সেতুবন্ধন তৈরি হয়ে যায়। খুব ভালো লাগত যখন আমার রান্না করা খাবার খেয়ে অফিসের কর্মকর্তারা বলতেন, “আপা, আপনার রান্না খেয়ে মনে হচ্ছে মায়ের রান্না/দাদির রান্না খাচ্ছি।”
আমি ফেরদৌস ওয়াহিদা আক্তার জ্যোতি। নিজেকে এখন একজন রাঁধুনি পরিচয় দিতেই ভালোবাসি। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেছি তাও বছর বিশেক হতে চলল। কিন্তু সেই ডিগ্রি কাজে লাগানো হয়নি। পাঁচ বছর আগে পর্যন্তও আমি ছিলাম একজন গৃহিণী। কিন্তু আজ আমার অন্য একটি পরিচয় আছে। বন্ধুদের উৎসাহে এবং স্বামীর অনুপ্রেরণায় ক্যাটারিং সার্ভিস শুরু করেছিলাম। শুরু থেকে চলছিলও খুব ভালো। কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতেই করোনা মহামারিতে ক্ষতির সম্মুখীন হলাম। সেই সার্ভিস থমকে গেল। অফিস বন্ধ, তাই খাবার সরবরাহও বন্ধ। অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে গেল আমার।
২০২৩ সালের নারী দিবস উপলক্ষে ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি মিলনমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। এই প্রথম এ ধরনের কোনো উদ্যোগে আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে আরও অনেক নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে দেখা হলো, পরিচয় হলো। কতজনের কতরকম স্বপ্ন! আমার স্বপ্নের কথা কেউ কেউ জানতে চাইছিলেন। আমি বলেছি, একদিন নিজের একটি বড় রেস্টুরেন্ট থাকবে- এটিই আমার স্বপ্ন!
করোনার পর আমি আবার ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। ঢাকার হাতিরপুল এলাকার ইস্টার্ন প্লাজা মার্কেটে ‘ঘরোয়া আপ্যায়ন’ নামে একটি দোকান দিয়েছি। আগে শুধু পরিচিতজনদের অর্ডার আর অফিসে দুপুরের খাবার দিতাম। এখন অনলাইন এবং অফলাইন দুই-ই চলছে।
আমার শ্বশুরবাড়ি পুরান ঢাকায়। বাড়ির মুরুব্বিদের রক্ষণশীল মানসিকতার কারণে চাকরি করার কথা আগে ভাবিনি। তবে ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করায় এবং বিশেষ করে মেয়ে পরবর্তীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় খরচ অনেকটা বেড়ে গেল। আমারও তখন সংসারের ব্যস্ততা কমে গিয়েছিল। তাই ভাবলাম এবার কিছু করতে পারলে মন্দ হতো না।
২০১৮ সালের কথা। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বন্ধুরা প্রায়ই বলত, রোজ হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে এনে খেতে হয় যা অস্বাস্থ্যকর এবং ব্যয়বহুল। তারাই একদিন প্রস্তাব দিল, অফিসে নিয়মিত খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
রান্না করতে আমার ভালো লাগে। রান্না করে সবাইকে খাওয়াতেও পছন্দ করতাম। কিন্তু কখনোই ভাবিনি একে ব্যবসা হিসেবে নেব। দু-একদিন একটু চিন্তা করে আমি রাজি হয়ে গেলাম। একটি বেসরকারি ব্যাংকে দশজনকে খাবার পাঠানোর মধ্যে দিয়ে আমার ক্যাটারিংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। করোনার মধ্যে থমকে যাবার আগে বিভিন্ন অফিস মিলিয়ে এই সংখ্যা হয়েছিল ৬০০! এসব অফিস সবই ছিল মতিঝিল এলাকায়। পিকআপ ভ্যানে করে খাবার পাঠাতাম। তবে এই কাজে যে চ্যালেঞ্জ নেই তা কিন্তু বলা যাবে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, নারীর কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা এবং সে অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা এখনও সমাজের অনেক পুরুষদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। এ কারণে দেখা যায়, আমি একটা কথা বললে পুরুষ সহকারীরা তা শুনতে গড়িমসি করে কিন্তু সেই একই কথা যখন আমার স্বামী বা ছেলে বলে তখন মেনে নিতে দ্বিধা করে না। এসব বাধা পেরিয়ে এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে আমারও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, ২০১৯ সালে প্রথম ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে নিজের প্রয়োজনে ৫০,০০০ টাকার ঋণ নিয়েছিলাম। ব্র্যাকের যে এই কার্যক্রম আছে তা জানতে পেরেছিলাম পরিচিত একজনের মাধ্যমে। করোনার মধ্যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে এবার সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুরে দাঁড়াতে অন্য কারও কাছে কিছু চাইব না। ব্র্যাকের ভাইদের ব্যবহার ভালো, তাদেরকে বললে নিশ্চয়ই আমাকে আবার ঋণ দেওয়া হবে। নিজের ব্যবসায় নিজেই এই সাহসী সিদ্ধান্ত নিলাম।
একজন মুক্তমনা মানুষ হিসেবে আমার স্বামী এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করলেন। আমার ছেলেমেয়েরাও আমার কাজে সর্বাত্মক সহায়তা করে। ওরা পাশে ছিল বলেই আজ যে আমি একজন গৃহিণী থেকে ‘ফুল-টাইম’ রাঁধুনি। এই পরিচয়টা সবাই দারুণভাবে মেনে নিয়েছে।
অনুলিখন: সুহৃদ স্বাগত
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা, সাব্বির আহমেদ ইমন
কারিগরি সহযোগিতা: ফুয়াদ রাব্বী শুভ্র
অসাধারণ, এখানে একটা বিষয় হচ্ছে, নিজের ভিতর আত্মবিশ্বাস, কর্মস্পৃহা, কাজ করার অদম্য উৎসাহ, এবং একটু সহযোগিতা মানুষ একটু একটু করে অনেক স্বপ্ন পূরণ করা যায়, ব্রাক এর একটু সহযোগিতা যে একটা মানুষকে ঘুরে দাড়াতে সাহায্য করে এটা তার বাস্তব উদহারন।
অসাধারণ, ব্র্যাকের একটু সহযোগিতা যে মানুষকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে সেটা আবার প্রমাণ হলো, এভাবেই এগিয়ে যাক।
Go ahead. Keep going mam