জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ মোকাবিলা বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয়। কিন্তু এই বিষয়ে আমরা কতটুকু জানি?
প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই আজকের নয়, চলছে আদিকাল থেকে। দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষ তাই নানা রকম পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। অন্যদিকে এখনকার বড়ো বাস্তবতা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহনীয় করার জন্য বিশ্বব্যাপী চলছে গবেষণা, নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি গত দুই দশকে মূলধারায় এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশেগত বৈশিষ্টের তারতম্য ঘটছে সেই সাথে বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুনরাবৃত্তির হার। সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমে বাড়ছে। এর জেরে উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে লবনাক্ততা, আকস্মিক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাত। বাংলাদেশের জন্য এটা বড়ো উদ্বেগের কারণ যে সাগরপৃষ্ঠের চেয়ে পাঁচ মিটারের কম উচ্চতায় রয়েছে দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা।
ধারণাগত দিক থেকে মিল থাকলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর প্রস্তুতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সামাল দেওয়ার মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম এবং মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে যা নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
- জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রস্তুতি মুলত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয় এবং অনাগত ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়িয়ে চলার জন্য অভিযোজন ও প্রশমন পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। অভিযোজন পরিবর্তিত অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রশমন বলতে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমানোর প্রচেষ্টাকে বোঝায়। অন্যদিকে, দুর্যোগ প্রশমন বলতে আক্ষরিক অর্থে এর ঝুঁকি হ্রাস করাকেই বোঝায়।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যতোটা সম্ভব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে, প্রস্তুতি হিসেব খাপ খাওয়ানোর উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি ব্র্যাকের জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি বা মিনি-সাইক্লোন শেল্টারের কথা। এর বৈশিষ্ট্য হলো এটি শুধু অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হইনি। এই বিষয়ে বরগুনার মিনারা আপার কথা না বললেই নয়। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে মিনারা আপার ঘর উড়ে যায়। মিনারা আপা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকতে শুরু করেন। অনেকের মতো ত্রাণ সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু তা দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে তুলতে পারেননি। জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির আওতায় আজ তার ভিটায় জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এই বাড়ির মডেল হচ্ছে, বাড়িটি দোতলা, নিচতলা ফাঁকা। ঝড়ের সময় এই বাড়ির নিচতলায় গবাদি পশু রাখা যায় । কর্মসূচির শর্ত অনুযায়ী ঝড়ের সময় এই বাড়িতে আশেপাশে পরিবারগুলোর অন্তত ২৫-৩০ জন আশ্রয় নিতে পারবে। এই বাড়িটির একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো এটি যথাসম্ভব নারীবান্ধব হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
- জলবায়ু সহিষ্ণু বাড়ি একজন মানুষের মনে আস্থা এবং আশা জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করেছে, জীবিকা এবং আয়ের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে, নারীর ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং আশপাশের অন্তত পাঁচটি পরিবারকে দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়ে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। সর্বোপরি, একজন মানুষকে দুর্যোগের পরে আবার নতুন করে পরিকল্পনা করার সক্ষমতা অর্জিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বলা যায়, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসের প্রস্তুতি কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সাময়িকভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সমাজকে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে সমাজকে কোনোভাবে রুপান্তর করার প্রয়োজন পরে না।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশের স্থায়ী পরিবর্তনের কথা মনে রাখা জরুরি। যেমন, উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ সুপেয় পানির বড়োই অভাব। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ব্র্যাক উপকূলীয় মানুষের দ্বারপ্রান্তে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার পদ্ধতি পৌঁছে দিয়েছে। এই পদ্ধতি অনুসরণের ফলে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে দুর্যোগের প্রস্তুতি যে ধরনের ঝুঁকি হ্রাস করে তার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি থাকতেও পারে আবার না-ও পারে।
- বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি গবেষণায় উঠে আসে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি থাকলে এবং আয়ের উৎস বন্ধ না হলে প্রতিটি পরিবার তাদের বার্ষিক আয়ের ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে। মোটা দাগে আমরা বলতে পারি যে, সংকট হওয়ার আগেই যদি প্রস্তুতি নেওয়া যায়, তাহলে তা মোকাবিলা করা সহজ হয়। যা আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনে। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে যে, আয়ের উৎস সুরক্ষিত থাকলেই কি অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে? একজন মানুষের আর্থিক সক্ষমতা থাকতে পারে, কিন্তু যে ধরনের সেবা ক্রয় করতে চাচ্ছেন তা হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সহজলভ্য নাও হতে পারে ।
- জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাসের প্রস্তুতি বা এর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পদ্ধতি কিছু অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করে। এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের নতুন দ্বার উন্মোচন, আর্থ-সামাজিক ক্ষতির ঝুঁকি কমিয়ে আনার মতো বিষয়।
একথা সত্য যে, জলবায়ু পরিবতর্নের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও ভয়াবহতা আরও বেড়ে যাবে। ফলে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি অবশ্যই একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে তাই এর প্রস্তুতিও হতে হবে যথাযথ এবং সময়ের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। অন্যথায়, গবেষকদের আশঙ্কা হলো শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বন্যাই দেশের মোট মাথাপিছু আয়ের ১.৫ শতাংশ ক্ষতি করবে।
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত