ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম ২০১৫-তে স্যার ফজলে হাসান আবেদ

April 26, 2024

‘ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট’ বইটিতে সেই দিনগুলোর কথার উল্লেখ আছে যখন আপনি চাকরি ছেড়ে দিলেন, লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করলেন এবং সম্পূর্ণ নিজের টাকা দিয়ে কাজ শুরু করলেন। অনেকটা এখনকার দিনের সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তাদের মতো। আপনি কি আমাদের সেই পরিস্থিতি, সেই সময়ের গল্প বলতে পারেন?

প্রশ্ন : ব্র্যাকের শুরুর দিনগুলোর গল্প মানুষকে আলোড়িত করে।  পুনর্বাসনভিত্তিক একটি সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ উন্নয়ন, অতঃপর সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ – এই ধারাবাহিক পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব হলো?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে আমি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসি এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ২ লাখ মানুষের কাছে রিলিফ পৌঁছে দেওয়া এবং পুনর্বাসনের কাজ শুরু করি। সেসময় বাংলাদেশ দারিদ্র্য এতটাই প্রকট ছিল যে, আমি বুঝতে পারলাম, রিলিফের কাজ শেষ হলেও এই মানুষদের এভাবে ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ তখন বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ। আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ ডলারের নিচে। প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। তার ওপর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৩ ভাগ। একেকজন নারী গড়ে ৬টির বেশি সন্তান জন্মদান করতেন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের চল ছিল না বললেই চলে। সবমিলিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

আমাদের প্রথম বড় কর্মসূচি ছিল শিশমৃত্যুহার কমিয়ে আনা। তখন ৫ বছরের নিচে শিশমৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজারে ২৫০ জন। আমরা ভাবলাম, ব্র্যাক যদি এই শিশুমৃত্যু রোধ করতে পারে, তাহলে হয়তোবা নারীদের সন্তানগ্রহণের হারও কমিয়ে আনতে পারবে। এই লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে গিয়ে মায়েদের শেখালাম কীভাবে খাওয়ার স্যালাইন বানাতে হয়। পরবর্তী ১০ বছরে আমরা ১ কোটি ৬০ লাখ পরিবারকে আমাদের এই কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে এলাম। তারপর সরকারের সঙ্গে টিকাদান কর্মসূচিতে আমরা কাজ করলাম। দেশের অর্ধেক এলাকায় আমাদের এবং বাকি অর্ধেক এলাকায় সরকারের প্রচেষ্টায় ২ বছরের কমবয়সী শিশুদের টিকাদান করা হলো। এর একটি বড় প্রভাব পড়ে নারীদের ওপর। ১৯৭২ সালে মাত্র শতকরা ৩ থেকে ৪ জন নারী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করতেন, আর ১৯৯০ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা ৬৫ জনে। এখন শিশুমৃত্যুহার নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ৪০ জনে । আমি বলব, উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দারুণ সফল হয়েছে এবং সরকার ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে ব্র্যাক সবসময় এই অভিযাত্রার অগ্রভাগে ছিল।

আমাদের খাদ্য উৎপাদনের কথাই ধরা যাক। আমরা ৯ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ১২ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করতাম। এখন আমরা ৮ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ৪৮ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করি। বাকি ১ মিলিয়ন হেক্টর জমি রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি ইত্যাদি গড়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়েছে। গত ৪০.বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতে আমরা এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের কৃষকরা অনেক দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। তাঁরা প্রতি একরে প্রায় ৭ টন ধান উৎপাদন করছেন। উৎপাদনের দিক থেকে আমরা চীন দেশের চাইতে একটু পিছিয়ে রয়েছি। চীন প্রতি হেক্টরে ১২ টন ধান উৎপাদন করে।

যেসব বিষয় নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম, তার প্রায় প্রতিটি নিয়েই আমি কাজ করেছি। মাতৃমৃত্যু হ্রাস আরেকটি বিষয় যা নিয়ে আমি ৩৫-৪০ বছর ধরে কাজ করেছি। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার যেখানে ছিল প্রতি লাখে ৮শ জন, সেখানে এখন এই হার নেমে প্রতি লাখে ১৭৫ জন। আর যেসব এলাকায় ব্র্যাক কাজ করছে, সেখানে এই হার আরও কম–প্রতি লাখে ১শ ৫০ জন। এ থেকে বোঝা যায় যে, কেউ যদি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সঠিক কর্মসূচি গড়ে তুলতে পারে তবে মাতৃমত্যু, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো সমস্যা মোকাবিলায় আবদান রাখা সম্ভব।

আরও একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাই যে, এসব কিছু ব্র্যাক একা করেনি। আমি বিভিন্ন ধরনের সংস্থা গড়ে তুলেছি, তার একটি হচ্ছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘ব্র্যাক’। এ ছাড়াও আমরা অনেকগুলো সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ গড়ে তুলেছি যেগুলো ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে চলছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। সেটিও বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে।  অবশ্যই অন্যান্য সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ও বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। আমরা সবাই মিলে এ কাজ করছি। তাই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানই যে শুধু উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিছু করবে না, ব্যাপারটি এমন নয়। আমি বিশ্বাস করি দেশের উন্নয়নে আমাদের সবারই কিছু না কিছু করার আছে।

প্রশ্ন :  ‘ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট’ বইটিতে সেই দিনগুলোর কথার উল্লেখ আছে যখন আপনি চাকরি ছেড়ে দিলেন, লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করলেন এবং সম্পূর্ণ নিজের টাকা দিয়ে কাজ শুরু করলেন। অনেকটা এখনকার দিনের সিলিকন ভ্যালির উদ্যোক্তাদের মতো। আপনি কি আমাদের সেই পরিস্থিতি, সেই সময়ের গল্প বলতে পারেন? নিশ্চয়ই ব্যাপারটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : ১৯৭০ সালে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে বয়ে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৩ লাখ লোক মারা যায়। আমি তখন শেল অয়েল কোম্পানিতে কাজ করতাম। শেল-এর একটি স্পিডবোটে করে আমি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপগুলোতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করলাম। আমার মনে হলো, ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে খারাপভাবে আঘাত করেছে দরিদ্র মানুষদের। তারাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারা গেছে। একই এলাকায় যেসব অধিবাসী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো উপযোগী বাড়িতে ছিল, তারা কোনোমতে বেঁচে গেলেও দরিদ্রদের বাড়িঘর সব ভেসে গেছে। তারা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এসব দেখে আমার মনে হলো, মানুষের জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তাটুকুও যেখানে নেই, সেখানে একটি বহুজাতিক কোম্পানির নির্বাহী হিসেবে আরামদায়ক জীবনযাপন করার কোনো অর্থ হয় না। পরিস্থিতি আমাকে নতুন কিছু শুরু করার জন্য ভাবিয়ে তুলল। এর ঠিক পরপরই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এবার আমরা লাখ লাখ মানুষকে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করতে দেখলাম। এসব ঘটনা আমাকে সম্পূর্ণই বদলে দিল। তখনকার পরিস্থিতিতে লন্ডনের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া, দেশে ফিরে এসে দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক একটা সিদ্ধান্ত বলেই মনে হয়েছিল; ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করছি তা টেরও পাইনি।

প্রশ্ন : প্রথম দিনগুলোতে ব্র্যাক অনেকটা স্টার্ট আপের মতো ছিল, তার সবকিছুই অন্যরকম ছিল।  ধীরে ধীরে এটি অনেক বড় একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে, একের পর এক নতুন কর্মসূচি যুক্ত হয়েছে, বিভিন্ন সেক্টরে কাজের আওতা সম্প্রসারিত হয়েছে। বলা চলে ব্র্যাক এক বৃহৎ বিশাল সংস্থায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে এক বিশাল সংস্থায় পরিণত হওয়া-এই পরিবর্তনকে আপনি সামলালেন কীভাবে?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : আমি মনে করি বড় সংস্থাকেও উদ্যোগী মনোভাবাপন্ন হতে হয়। অনেক বড় হলেও সংস্থা কখনও এক জায়গায় থেমে থাকে না, সেটিকে পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয়, নতুন সুযোগ খুঁজে নিতে হয়, সর্বোপরি উদ্ভাবন করতে হয়। যদিও ব্র্যাক অনেক বড় একটি সংস্থা, তবু আমি মনে করি আমরা পরিবর্তনকেই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করি। প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত হতে আমরা সবসময় প্রস্তুত আছি। আমাদের সোশ্যাল ইনোভেশন ল্যাব রয়েছে, আমরা সারাক্ষণ নতুন জিনিস শিখছি। আমাদের কর্মীদের মধ্যে অনেকের দারুণ সব আইডিয়া রয়েছে যেগুলো থেকে আমি অনেক কিছু শিখি। কারণ শেখার কোনো শেষ নেই।

সারাদেশে কর্মসূচি ছড়িয়ে দিতে আসলে কী প্রয়োজন? ছড়িয়ে দেওয়ার নিজস্ব গতিগ্রকৃতি রয়েছে। প্রথমে চিন্তা করতে হবে আপনি কী ছড়িয়ে দিতে চান? অবশ্যই এমন কিছু যা সফল হয়েছে। তাই সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে যাতে হস্তক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো এটা নিশ্চিত করা যাতে হস্তক্ষেপ কার্যকর হয়। যখন এ দুটোই নিশ্চিত হয়, কেবল তখনই দেশব্যাপী কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়াটা অর্থ বহন করে। একইসঙ্গে সংস্থাকেও ছড়িয়ে দেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। সংস্থায়  বিপুলসংখ্যক কর্মী নিয়োগ করার মতো সক্ষম একটি মানবসম্পদ বিভাগ থাকতে হবে। একটি প্রশিক্ষণ বিভাগ থাকতে হবে, যা কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের জন্য গড়ে তুলতে পারে। হিসাবরক্ষণ বিভাগ ও নিরীক্ষা বিভাগ থাকতে হবে। সারাদেশে কর্মসূচির বিস্তার ঘটাতে হলে এসব অবকাঠামো গড়ে তোলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সংস্থার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। দাতাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হলে কী প্রয়োজন? তারা প্রথমে দেখবে পাইলট প্রজেক্ট কেমন চলছে। যদি পাইলট প্রজেক্ট তাদের ভালো লাগে তা হলে হয়তো তারা প্রকল্পটিকে আরও সম্প্রসারণ করতে উৎসাহী হবে। ব্র্যাকের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে কর্মসূচি সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিলাম, দাতারা তাতে সম্মত হয়নি। তারা বলেছে এ বছর তারা ২০টি শাখায় কর্মসূচি সম্প্রসারণের জন্য অর্থ দিলে আগামী বছর হয়তো ৩০টি শাখার জন্য অর্থ দিতে পারবে। আমাদের কখনও কখনও তাদের পরামর্শ মেনেই চলতে হয়েছে, কাজের দ্রুত সম্প্রসারণ করার ইচ্ছে থাকলেও অর্থের অভাবে করা সম্ভব হয়নি।

আমাদের যতটা সম্ভব সাশ্রয়ীভাবে কাজ করতে হয়েছিল। আমার মনে আছে, প্রথম যখন আমরা ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য ইংল্যান্ডের অক্সফাম থেকে অর্থসহায়তা পাই তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি হারানো মানুষদের জন্য ১০ হাজার ২শ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা। আমরা গ্যালভানাইজড আয়রন শিট, বাঁশের খুঁটি ও মাচা সংগ্রহ করলাম। খুব কম খরচে এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো তৈরি করা হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম কারও কাছ থেকে কোনো ফি গ্রহণ করব না। কিন্তু পরে দেখলাম, কেউ কেউ আছে যারা এই ঘরগুলোর জন্য অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য রাখে। সকলেই হতদরিদ্র, এমনটি নয়। যখন আমরা বুঝলাম কেউ কেউ আংশিকভাবে হলেও ঘরের খরচ বহন করতে পারবে, তখন তাদের কাছ থেকে আমরা সেটি গ্রহণ করলাম। আমরা তাদের বললাম যেসব জিনিস আমরা তাদের দিচ্ছি, তার বাজারমূল্যের অর্ধেক খরচ তাদের বহন করতে হবে। আর যারা সত্যিকার অর্থেই দরিদ্র ছিল এবং একটি পয়সাও ব্যয় করার মতো অবস্থায় ছিল না, তাদেরকে আমরা বিনামূল্যে সবকিছু বিতরণ করলাম।

ত্রাণ বিতরণের মতো একটি কর্মসূচির ক্ষেত্রেও আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যারা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল তাদের কাছ থেকে মূল্য আদায় করা, যাতে আমরা কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারিত করতে পারি। যখনই আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি, যেখানে লোকজনকে আর্থিকভাবে সম্পৃক্ত করা সম্ভব, আমরা তা করেছি এবং এখনও আমরা তা করে চলেছি। কিছু ব্যতিক্রম ছিল-যেমন শিক্ষা কর্মসূচিতে আমরা এমনটি করিনি, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা শিশুদের কাছ থেকে কখনও কোনো ফি নিইনি।

১৯৮৫ সালে আমরা যখন বাংলাদেশে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করি, তখন স্লেট থেকে শুরু করে বই, পেন্সিল, খাতা সবকিছুই ফ্রি ছিল। কিন্তু এখন আমরা দেখছি বাংলাদেশ আর ১৯৮৫ সালের মতো দরিদ্র নেই। আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে ৩ গুণ হয়েছে। এখন ব্র্যাক থেকে যে সকলেরই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষা পেতে হবে, এমনটি নয়। কারও কারও এখনও সেটির প্রয়োজন রয়েছে। আবার পাশাপাশি এমন অনেকে আছে যারা শিক্ষার জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম। তাই আমরা এখন এমন কিছু স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবছি, যেখানে শিক্ষার্থীরা অন্তত খরচটুকু বহন করতে পারবে। আর যারা একেবারেই পারবে না, তাদের জন্যও স্কুল থাকবে, যেখানে তারা এখনকার মতো বিনা খরচে পড়াশোনা করতে পারবে।

প্রশ্ন : তাহলে দেখা যাচ্ছে সাশ্রয়ী মনোভাব বা অন্তত খরচ তুলে আনার বিষয়টি ব্র্যাকের অনেক কর্মসূচির মধ্যেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এর কারণ কী? কম খরচে বেশি মানুষকে সেবা দেওয়া? নাকি সংস্থাকে স্বনির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে নেওয়া?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : মূলত সাশ্রয়ী উপায়ে বেশি মানুষকে সেবা দেওয়া । আমরা ভেবেছিলাম যদি সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে আমাদের সেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে যারা সেবার মূল্য পরিশোধ করতে পারে, তাদের কাছ থেকে আমরা কেন নেব না? এতে করে যারা কিছুই দিতে পারবে না, তাদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করা যাবে। এটিই ছিল ব্র্যাকের চিন্তাধারা এবং এখনও আমরা এভাবেই কাজ করি।

প্রশ্ন : এভাবে কাজ করার ফলে নিশ্চয়ই ব্র্যাক অনেকটা স্বনির্ভর হতে পেরেছে। আপনি কী মনে করেন?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : কিছুটা তো অবশ্যই। যেমন আমাদের নতুন স্কিল কর্মসূচির কথাই ধরা যাক্‌। আমরা মনে করি যারা খুবই দরিদ্র তাদের আমরা বিনামূল্যে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দিতে পারি। তারা যদি এই প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে চাকরি পায়, নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয় সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কিছু কিছু প্রশিক্ষণ আছে যেগুলো ব্যয়সাপেক্ষ এবং এসব প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে প্রশিক্ষণ গ্রহীতাদের সামনে অর্থ উপার্জন করার বেশ ভালো সুযোগ থাকে। এজন্য এসব প্রশিক্ষণ নিতে উৎসাহী লোকজন কিছুটা খরচ করতেও আগ্রহী। এক্ষেত্রে আমরা ফি নিতে পারি। ধরা যাক, আপনি কাউকে এমন ধরনের প্রশিক্ষণ দিলেন, যাতে সে সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশে আগে যা উপার্জন করত তার ৫ গুণ উপার্জন করতে পারে। এমন ব্যক্তি প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য খরচ করতে দ্বিধা করবে না এবং আমরাও তার কাছ থেকে ফি নেব। বাংলাদেশে আমরা ধাত্রীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি এবং আমি তাদের নিজ গ্রামে পাঠাতে চাই, যাতে তারা সেখানকার নারীদের কাছে সেবা পৌঁছে  দিতে পারে। আমরা বিনামূল্যে এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ৩ বছরের এই প্রশিক্ষণে প্রতি প্রশিক্ষণার্থীর জন্য ব্যয় হচ্ছে ১৩ হাজার ডলার (১০ লক্ষ ১৪ হাজার টাকা)।

আমরা এই প্রশিক্ষণ বিনামূল্যে দিচ্ছি, কারণ আমরা চাই তারা নিজেদের এলাকায় ফিরে সেবা প্রদান করুক, নিজেরা একেকজন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু করুক। শর্তের কারণে আমরা কোনো ফি নিচ্ছি না। কিন্তু আমরা যদি তাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিই, যাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বছরে ৬০ হাজার ডলার উপার্জন করতে পারে, তাহলে অবশ্যই আমরা সেই প্রশিক্ষণ বিনামূল্যে দেব না।

প্রশ্ন : গত দুদিনের আলোচনায় একটি বিষয় বারবার উঠে এসেছে আর তা হলো সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ ও উদ্যোক্তাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। ব্র্যাক এক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : এ বিষয়ে আমরা প্রথম কাজ শুরু করি ১৯৭৪ সালে মাইক্রোফাইন্যান্স  কর্মসূচির মাধ্যমে। তখন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার মধ্যে আমাদের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৯৫ সালে একটি গবেষণায় উঠে এলো যে, বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে এবং ধনীরা সম্পদ গচ্ছিত রেখে ব্যাংক থেকে সহজেই খণ নিতে পারছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এ ধরনের কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যবর্তী একটি বড় অংশ ঋণের আওতার বাইরে ছিল। ব্যাংক তাদের খণ দিতে চাইত না।

ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও তারা সহায়তা পেত না। আরেকটি বিষয় উঠে আসে যে, যারা সবচেয়ে দরিদ্র, বাংলাদেশের শতকরা ১০ ভাগ মানুষ, তারাও ক্ষুদ্রঋণের সুবিধার বাইরে। এই দুটি ফলাফল আমাকে দুটি নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করে। এরকম একটি প্রজেক্ট হলো ব্র্যাক ব্যাংক। আমি ব্র্যাক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি প্রধানত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরকে ঋণসুবিধা দেওয়ার জন্য। যেহেতু এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক, তাই এর বাইরেও কর্পোরেটঋণসহ অন্যন্য আর্থিক সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা।

দ্বিতীয় প্রজেক্টটি ছিল অতিদরিদ্রদের জন্য৷ বাংলাদেশের শতকরা ১৭ ভাগ জনগণ এতটাই দরিদ্র ছিল যে, তাদের পক্ষে ঋণ গ্রহণ করে তা ফেরত দেওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তাদের প্রয়োজন ছিল অনুদান । তাদের জন্য আমরা ‘গ্র্যাজুয়েশন মডেল’ চালু করলাম। আপনারা অনেকে এই মডেলের কথা শুনেছেন, যেখানে অতিদরিদ্রদের শুধু অনুদান নয়, দু’বছর ধরে তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা এবং পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। একইসঙ্গে তাদের নিজেদের সমাজের মধ্যে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিদরিদ্ররা সমাজের মধ্যে বাস করেও অনেকটা একঘরে হয়ে থাকেন। এমনকি নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও তাদের তেমন কোনো সম্পর্ক থাকে না। আমরা তাদের সামাজিক কাঠামোতে পুনরায় ফিরিয়ে আনি। দু’বছর ধরে এসব করার পরে দেখা গেল তাদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। এই. মডেল নিয়ে এখনও পর্যন্ত নানা গবেষণা হয়েছে। এমআইটি ইউনিভার্সিটির জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব, ইয়েল ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস ব্র্যাকের এই মডেল অন্য ৮টি ( অথবা ১০টি) দেশে বাস্তবায়নকারী প্রকল্পগুলো নিয়ে গবেষণা করছে।

সবগুলো গবেষণায় উঠে এসেছে কর্মসূচি থেকে বের হয়ে আসার ৪ বছর পরও অতিদরিদ্রদের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে কেউ কেউ ‘বিকাশ’ নিয়ে কথা  বলেছেন। ‘বিকাশ’ দারুণভাবে চলছে এবং আশা করি একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা লেনদেন থেকে শুরু করে সঞ্চয়, ঋণগ্রহণ সবকিছুই করতে পারবে। এখন ‘বিকাশ’-এর গ্রাহক প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ এবং প্রতিমাসে আরও ৫ লাখ নতুন গ্রাহক-এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ২০১৬ সালের মধ্যে আমরা হয়তো আড়াই কোটি গ্রাহককে এর আওতায় আনতে পারব। আমি আশাবাদী, ‘বিকাশ’ পৃথিবীর মধ্যে মোবাইল মানির সবচেয়ে বড় কার্যক্রম হয়ে উঠবে। আর্থিক সেবার সুবিধা সবার কাছে পৌঁছে যাবে।

প্রশ্ন : এতক্ষণ আমরা বাংলাদেশ নিয়ে কথা বললাম। ব্র্যাক আরও অনেক দেশে তার কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছে। সেসব দেশেও কি আপনি একই ধরনের সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করছেন?

স্যার ফজলে হাসান আবেদ : হ্যাঁ এবং না।  আমি বলব অন্য দেশগুলোতে আমরা একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছি। কারণ আফ্রিকার কিছু দেশ, বিশেষত লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিওন  খুবই দরিদ্র।  তবে একটা কথা সত্যি যে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনধারা, তাদের আশা-আকাঙ্খা, স্বপ্ন ও সংগ্রাম পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় একরকম। ব্র্যাক বাংলাদেশে যে ধরনের কাজ করে, তার অনেক কিছু আফ্রিকাতেও সফল হয়েছে, যদিও সেগুলোকে আফ্রিকান ধাঁচে করতে হয়েছে। ব্র্যাক আফ্রিকার কর্মীরা সেসব কাজ করছেন।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments