আহমেদাবাদের সরু গলির পতিতালয়ে আশ্রয় হয় তার। সেটি এক দূর্ভেদ্য দূর্গ। মূল ফটকে প্রহরী, ভেতরেও অসংখ্য প্রহরী। প্রত্যেককে বন্দী করে রাখা হয়েছে আলাদা কক্ষে। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, টয়লেট সবকিছু। কক্ষের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, অন্য কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ নেই। বোনকে দেখারও উপায় নেই। তবে জানলেন ছোটো বোনও এখানেই পাশের কোনো কক্ষে আছে। দুই বোনকেই জোরপূর্বক যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হলো। অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন।
কী নিদারুণ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে মানব পাচারের শিকার হওয়া মানুষদের যেতে হয়েছে, তা ভাবাও যায় না। তবে যে কাহিনীটি আজ শোনাব, তা সিনেমাকেও হার মানায়।
শুরু করার আগে পেছনের কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। ২০১৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। ফিল্ড ভিজিটে যশোর গিয়েছিলাম ৩ দিনের জন্য। সঙ্গে ব্র্যাকের সহকর্মীরা ছিলেন। ব্র্যাক তখন মানব পাচার রোধে একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছিল। সেই প্রকল্পের পরিকল্পনা করার জন্যই যশোরের পথে-প্রান্তরে ঘুরছিলাম। দিনভর বিভিন্ন এনজিও’র সঙ্গে মিটিং। মানব পাচারের শিকার নারী-পুরুষের সঙ্গে কথাও বলেছি। এ অঞ্চলের মানব পাচারের স্বরূপ বুঝে নির্ধারণ করা হবে পরিকল্পনা।
দিনের শেষ এজেন্ডা ছিল ব্র্যাক মানবাধিকার এবং আইন সহায়তা কর্মসূচির সঙ্গে মিটিং। আমাদের অনুরোধে কর্মসূচির পক্ষ থেকে ১০ জন নারীকে মিটিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ওই নারীরা তাদের গল্প আমাদের সামনে তুল ধরেন। একে একে ৫/৬ জনের জীবনের বাস্তব গল্প শুনে শিউরে উঠেছিলাম।
পাচার হওয়া প্রত্যেকেরই রয়েছে নির্মম অভিজ্ঞতা। কেউ পাঁচ-ছয় বছর পর দেশে ফিরেছে। কারও মেয়ে এখনও ভারতে আটকা পড়ে আছে, কারও স্ত্রীর খোঁজ নেই ১০ বছর। কেউ মা, কেউবা বোনকে হারিয়েছে। যাদের পরিবারের সদস্যরা এখনও আটকা পড়ে আছে, তারা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, স্যার, কিছু একটা করেন। সকলের কান্নাকাটি, কাকুতি-মিনতি আর ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় সেদিনের পরিবেশ ক্রমেই ভারী হয়ে উঠেছিল।
এমন পাঁচজন নারী মিটিংয়ে এসেছিলেন, যারা ব্র্যাকের সহায়তায় দেশে ফেরত এসেছেন। সবার সঙ্গে কথা বলা শেষে আমরা ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। একটু আগে যিনি বলছিলেন, তার শেষ বাক্য ছিল, ‘আমাদের ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। কিন্তু এই পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যদি বিচার করতে পারেন, আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই।’
এমন সময় একজন মাথা নিচু করে বললেন, ‘হ স্যার, মরার আগে আর কোনো চাওয়া নেই। খালি যদি বিচারটা দেখে যেতে পারি, তাইলে শান্তিতে মরতে পারি।’
খেয়াল করলাম, এতক্ষণ সকলেই নিজের কাহিনি বললেও এই মানুষটি নীরবে শুধু শুনছিলেন। এই প্রথম কথা বললেন। শিহাব ভাই বললেন, ‘আপা আপনার কথা শোনা হয়নি, আপনি কী একটু বলতে চান?’ মেয়েটি বললেন, ‘আমার কথা বলে আর লাভ কী ভাই, কতজনকেই তো বললাম, কেউ তো আর ওদের বিচারের আওতায় আনতে পারল না’।
আমরা চুপ করে ছিলাম। বুঝতে পারলাম একই গল্প বারবার বলা মানেই নতুন করে ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়া। এরপর নীরবতা ভেঙে শুরু হয় মেয়েটির কথা।
মেয়েটির নাম সুমি (ছদ্মনাম)। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সে বড়ো। বাকি তিনবোন, একভাই ও বাবা-মার সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। কিছুদিন সৌদি আরবে গৃহ পরিচারিকার কাজ করেছেন। বাবা-মা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাদের দেখভাল করতে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু কতদিন আর বেকার বসে থাকা যায়। সংসারের খরচ মেটাতে কাজ তো করতেই হবে।
অনেকদিন নিজ এলাকাতেই কাজ খুঁজছিলেন। এই সুযোগটাই নেন তার এক প্রতিবেশী চাচা।
একদিন বাড়িতে এসে বলেন, ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। দুই বোনকেই কাজ দেওয়া যাবে। বেতনও ভালো। সব শুনে বাবা-মাও রাজি হলেন। সুমি ও তার ছোটো বোন নাঈমা (ছদ্মনাম) প্রতিবেশীর সঙ্গে ঢাকায় রওনা হলো।
প্রাইভেট কারে দু’বোনকে উঠিয়ে রওনা হলেন ওই চাচা। পথে বললেন, ‘তোরা তো বমি করে গাড়ি নষ্ট করবি। এই ওষুধটা খেয়ে নে।’ দু’বোন সরল মনে খেল।
কিছুক্ষণ পরেই তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। পরের দুদিন আর ঘুম ভাঙল না। যখন ভাঙল, তখন তারা নিজেদের আবিষ্কার করল বন্দী অবস্থায়, ভারতের পশ্চিম বাংলায়। সেখান থেকে দুয়েকদিনের মধ্যে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় গুজরাটের আহমেদাবাদে।
আহমেদাবাদের সরু গলির পতিতালয়ে আশ্রয় হয় তার। দূর্ভেদ্য দূর্গের মতো যেন সেই জায়গা। মূল ফটকে প্রহরী, ভেতরেও অসংখ্য প্রহরী। প্রত্যেককে বন্দী করে রাখা হয়েছে আলাদা কক্ষে। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, টয়লেট সবকিছু। কক্ষের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই, অন্য কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ নেই।
বোনকে দেখারও উপায় নেই। তবে জানলেন ছোটো বোনও এখানেই পাশের কোনো কক্ষে আছে। দুই বোনকেই জোরপূর্বক যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হলো। অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। প্রমাণস্বরূপ পিঠে ছুরির আঘাতের চিহ্নও দেখালেন।
একসময় মেনে নেন। দু’মাস যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। সেখানে আরও অনেক বাংলাদেশী মেয়ের দেখা পেলেন। পতিতালয়ের একটি দালাল চক্র কিছুদিন পরপর বাংলাদেশে গিয়ে মেয়েদের পাচার করে এখানে আনে। একবার আনতে পারলেই আজীবন থাকতে হবে।
দু’মাস ধরে সুমি পালানোর পথ খুঁজেছেন। অনেক পরিকল্পনার পর, অনেক কষ্টে একসময় পালাতে সক্ষম হন। কিন্তু বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় তাকে ছাড়াই চলে আসতে হয়। আহমেদাবাদ থেকে প্রথমে কলকাতা এবং তারপর স্থানীয় সরকারের সহায়তায় দেশে আসা। দাপ্তরিক সকল কাজ শেষ করে দেশে ফিরতে দু’মাস লেগে যায়।
‘আমি তো মুক্তি পাইসি। কিন্তু আমার বোন সারাজীবন ওখানে কাটাবে, তা কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না। দেশে ফিরেও ভালো লাগছিল না।’ কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন সুমি। ঠিক করলেন কিছু একটা করতে হবে। এই চিন্তা থেকেই পাসপোর্ট-ভিসা করে বেনাপোল হয়ে একাই চলে গেলেন ভারত। সেখানে গিয়ে যোগাযোগ করলেন এক আইনজীবির সঙ্গে। পুলিশের সঙ্গেও কথা বললেন।
কিন্তু ওই পতিতালয়ের মালিক প্রভাবশালী হওয়াতে পুলিশকে খুব উৎসাহী মনে হলোনা। শেষে উপায় না দেখে ঠিক করলেন, একাই পতিতালয়ে যাবেন। উদ্ধার করবেন বোনকে। এতে ঝুঁকির কমতি নেই। ‘আমি জানি, একবার ওখানে ঢুকলে জীবনে আবার বের হতে পারব কিনা জানিনা। হয়তো আজীবন পতিতা হিসেবে কাজ করতে হবে। ধরা পড়লে মেরেও ফেলতে পারে। কিন্তু আমার বোনকে বাঁচানোর জন্য আমি আবার পতিতা হইসি, আমার কোনো উপায় ছিলনা’ সুমির মুখে এই কথাগুলো শুনে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
বেশভূষা পাল্টে আবার সেই পতিতালয়ে গিয়ে হাজির হন সুমি। যাওয়ার আগে আইনজীবিকে বলে যান, আমি যদি ৬ মাসের মধ্যে বের হতে না পারি, তাহলে পুলিশ নিয়ে গিয়ে যেন তাকে উদ্ধার করেন। আইনজীবী কথা দিলেন, বের হতে না পারলে পুলিশ বাহিনী নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনবেন।
কিছুদিনের মধ্যে বোনের রুম খুঁজে বের করলেন। বেশভূষা পাল্টালেও তাকে চিনতে বোনের ভুল হলো না। সুমি পরিকল্পনা করতে থাকেন। আইনজীবীর কুশলী বুদ্ধিতে কয়েক মাস পরেই দুজনে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। সুমি কল্পনাও করতে পারেন নি, তার এই পরিকল্পনা সফল হবে।
তারপর আগের প্রক্রিয়ায় কলকাতা হয়ে দেশে ফেরেন। ফিরে দেখেন, সেই পাচারকারী চাচা আবারও ফিরে এসে নতুন পাচারের ফন্দি আঁটছে। সুমি তার নামে মামলা করেন। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয় না। উল্টো সে বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যায়। পাচারকারী এলাকাতে মাথা উঁচু করেই চলে। বিচার প্রক্রিয়া ধীর হওয়াতে আদৌ সুবিচার পাবে কিনা, পেলেও কবে পাবে জানা নেই সুমির।
আক্ষেপের সুরে সুমি বলতে থাকেন, ‘আমার জীবন তো শেষ। এই জীবনে আমার কিছু চাওয়ার নেই। শুধু একটি অনুরোধ, যে আমাকে আর আমার বোনকে পতিতা হতে বাধ্য করল, একবার মুক্তি পাওয়ার পরে আবারও ওই জীবনে ফিরে যেতে বাধ্য করল, তার যেন শাস্তি হয়। আপনারা পারবেন আমারে সহায়তা করতে?’
সুমির প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারলাম না। শুধু ব্র্যাক মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচির এলাকা ব্যবস্থাপককে অনুরোধ করলাম, তার কেসটি যেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা দেখেন। সুমির সেই তীক্ষ্ণ প্রশ্নটি এখনও কানে বাজে। তিনি তো শুধু আমাদেরকেই প্রশ্ন করেননি। এই প্রশ্ন তিনি ছুঁড়ে দিয়েছেন নির্মম এই পৃথিবী আর সমাজের কাছে। যে সমাজে মানব পাচারের শিকার দু’বোন আতঙ্ক নিয়ে বাঁচে, আর পাচারকারী মাথা উঁচু করে চলে নতুন শিকারের খোঁজে।
সম্পাদনা: ইকরামুল কবীর, তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত
ফটো ক্রেডিট: সাদিকুর রহমান
sad