কর্মজীবী মা এবং কিছু কথা

May 9, 2019

এখনও বাংলাদেশের অনেক অফিসে কর্মজীবী মায়ের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার নেই। অনেক অফিস এখনও সবেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুবিধা দিতে গড়িমসি করে।

খুব ভোরে মোবাইলের অ্যালার্মের ডাকে ঘুম ভাঙে মায়ের। ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা। অফিসে যাওয়ার জন্য নিজের প্রস্তুতি তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে সন্তানকে রেডি করার তাড়া। মায়ের সঙ্গে সে-ও তো অফিসে যাবে। অফিসের ডে কেয়ার সেন্টারে থাকবে যতক্ষণ তার মা কাজ করবে। তাই তো ভোর থেকে বাচ্চার  খাবার তৈরি, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে সময়মতো অফিসে যাওয়ার ভীষণ তাড়া মায়ের। নিজের ক্যারিয়ার, অফিসের ব্যস্ততা থাকলেও সন্তানের যত্নআত্তির ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয় মা। কিন্তু এখনও বাংলাদেশের অনেক অফিসে কর্মজীবী মায়ের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার নেই। অনেক অফিস এখনও সবেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য সুবিধা দিতে গড়িমসি করে।

সংসারের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি ছেলেমেয়েকে পড়ানো, স্কুলের খোঁজখবর রাখার দায়িত্বগুলো মা খুশিমনে নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। এভাবে কখনও প্রয়োজন, কখনও নিজের ইচ্ছেতেই ব্যস্ত থাকেন মা। সত্যি বলতে কি, আমাদের জীবন আগের চাইতে অনেক গতিশীল হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের বোঝাপড়ার বিষয়গুলো সেকেলেই রয়ে গেছে। তাই সংসারে মায়ের ছুটি নেওয়া চলে না। সবাইকে তুষ্ট করে তবেই তো আত্মতুষ্টি হবে। আর এজন্যই নারীর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে গৃহকর্ত্রীর খেতাব। আগে পরিবারে প্রধানত বাবা চাকরি করতেন, এখন দেখা যায়, মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। কিন্তু ঘরের সব কাজ, সন্তান লালনপালনের দায়দায়িত্ব প্রধানত নারীকেই পালন করতে হয়। ফলে ছুটির দিনগুলোও হয়ে ওঠে আরও বেশি ব্যস্ততাময়।

এ তো গেল শহুরে কর্মজীবী মায়েদের গল্প। গ্রামের বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মায়েরা আরও কঠিন জীবনসংগ্রামের মুখোমুখি হয়। তাদের কথা ভাবতে গিয়ে আবেদভাই, স্যার ফজলে হাসান আবেদের একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়  ব্র্যাক রংপুরের রৌমারিতে ত্রাণ সহায়তা কর্মসূচি চালু করে। সেসময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি রংপুরে গিয়েছি। তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। রংপুরে অনেক শিশুকে আমি দেখেছি যাদের বাবা সব দায়দায়িত্ব ফেলে পালিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো বৌ-বাচ্চার খাবার জোগাড় করতে পারেননি বলে অন্যত্র কাজের সন্ধানে গেছেন। কাজ পাননি বলে তিনি আর ফিরে আসেননি। যে কারণেই হোক তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছেন। কিন্তু মা তার সন্তানকে ফেলে চলে যাননি। তার নিজের পেটেও খাবার নেই। বাচ্চাও খেতে না পেয়ে চোখের সামনে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। কিন্তু সন্তানকে ফেলে তিনি পালাতে পারছেন না। আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেন মহিলারাই। বাচ্চার পেটে যদি খাবার না থাকে, তাহলে কার কাছে এসে কান্নাকাটি করবে? মায়ের কাছে। ঘরে যদি খাবার না থাকে মা তখন পাশের বাড়ি বা অন্য কোথাও থেকে খাবার এনে বাচ্চাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। একজন আত্মীয় যখন বাড়িতে আসেন, তখন ঘরে কিছু না থাকলেও ধার-কর্জ করে তিনি তাকে আপ্যায়ন করেন। সামাজিক দায়দায়িত্বগুলো সবই তিনি পালন করেন। আমি নিশ্চিতরূপেই দেখেছি, মহিলারা নিজের পরিবারের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল। এজন্যই মহিলাদেরকে সংগঠিত করে তাদের আয়ের ব্যবস্থার কথা সবসময় ভেবেছি।’

মায়েদের জন্য বাস্তব সত্য এটাই, মা তার ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ থেকে কখনও পিছিয়ে আসতে পারেন না। সন্তানকে নিয়েই চালিয়ে যায় অবিরাম লড়াই। আসলে  মা এবং সন্তানের সম্পর্কটাই এমন। এই বন্ধন যত দৃঢ় হয় সমাজের মূল্যবোধের জায়গাটিও তত মজবুত হয়। মা ছেলেমেয়ের জন্য কখনও বন্ধু, কখনও শিক্ষক, কখনও আদর-আহ্লাদের একমাত্র স্থান।

গত বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রতিবেদন বলছে দেশের শ্রমশক্তিতে থাকা সম্ভাবনাময় সাড়ে ৩৪ লাখ নারীকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না (সূত্র: প্রথম আলো, সুযোগ-সংকটে হারাচ্ছে সম্ভাবনা, ২৯শে এপ্রিল ২০১৯)। এই নারীদের অনেকে সংসারের ঝক্কিঝামেলায় চাকরি করতে পারছেন না। সংসার, সন্তান, চাকরি সবকিছুর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে তাই মায়েদের জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ। সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার হাজারও দায়িত্ব কেবল মায়ের কাঁধে তুলে দিলে হবে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেইসঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট কাজ পুরুষের বা কোনো নির্দিষ্ট কাজ নারীর-এই ধারণা থেকেও বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

সন্তান ঘরের আচরণ থেকেই প্রথম সবকিছু শেখে। পরিবারের প্রত্যেকে যদি পারস্পরিক পরিচর্যা ও স্নেহের সম্পর্ক লালন করে, তাহলেই আমরা প্রকৃত সুখী ও সুন্দর জীবনের সন্ধান পাব। মা দিবস এমন মানবিক সম্পর্কগুলোকে আরও এগিয়ে নেওয়ার দাবি রাখে। মা দিবসে সকল মাকে জানাই শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments