কৈশোরে হঠাৎই আসে পরিবর্তন। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে তাই প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীর স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি।
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমি কাজ করি ঢাকার বস্তি এলাকায়। কাজ করতে গিয়ে প্রথমেই দেখলাম, ঢাকার বস্তি এলাকার মা-বাবারা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে। ফলে এই বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েরা এমনিতেই সব জেনে যাবে- এই সংস্কৃতিও কখনও কখনও মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্ক সহজ ও খোলামেলা হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে সে প্রথাটাই ভাঙার চেষ্টা করছি।
এই কথাগুলো বলেছেন ঢাকা ইয়ুথ অ্যাডভোকেট বিল্লাল। গত ১০ই মার্চ ২০১৯ তারিখে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি ও রাইট হেয়ার রাইট নাও বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় জাতীয় পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ে মতবিনিময় কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিল ৮টি বিভাগ থেকে ৯০ জন ইয়ুথ অ্যাডভোকেট। তাদের মধ্যে বিল্লাল একজন। ব্র্যাক-আরএইচআরএন-এর ইয়ুথ অ্যাডভোকেটদের প্রতিটি দলে ১৫ জন করে সদস্য আছে। তারা মাধ্যমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। প্রতিটি দল নিজ নিজ এলাকায় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষাবিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, নাটক, উঠান বৈঠক, বিভিন্ন ইভেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম পরিচালনা করে। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি প্রথমে তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে তিনদিনের প্রশিক্ষণ দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, রাইট হেয়ার রাইট নাও বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্ম ১০টি সংস্থা এবং একটি অ্যালায়েন্সের সমন্বয়ে গঠিত। ব্র্যাক এই প্ল্যাটফর্মের সদস্য। পরিবার থেকে পলিসি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে পরিচালিত এসআরএইচআর উদ্যোগগুলোতে যারা কাজ করছে তাদের ৫৫% তরুণ।
বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন (২০১৫) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৭.৬ মিলিয়ন বা শতকরা ৩০ ভাগ জনসংখ্যা ১০-২৪ বছর বয়সি কিশোর ও তরুণ। বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, বিদ্যালয়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব এবং মা-বাবা, আত্মীয়¯স্বজন ও শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা না পাওয়ার কারণেই তারা ভুল জানে, ভুল কথা বিশ্বাস করে এমনকি সঠিক তথ্য না জানার কারণেই কখনও কখনও খারাপ লোকেদের পাল্লায় পড়ে যায়। ফলে হারিয়ে যায় তাদের জীবনের ছন্দ। কৈশোরে হঠাৎই আসে পরিবর্তন। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে তাই প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীর স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরি।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি পরিবার যদি মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালের বিষয়গুলোকে উদ্যাপন করে, সবাইকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তাহলে সারা দেশে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জায়গা তৈরি করা সম্ভব।’
কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. আইনুল কবির। তিনি বলেন, ‘আজকের কিশোর-কিশোরীরাই আগামীতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।’ এই কথার সত্যতাই যেন উঠে এসেছে কর্মশালার ইয়ুথ অ্যাডভোকেটদের কথায়। তারা শুনিয়েছে পরিবর্তনের কথা, আশার কথা।
লেখাটি শেষ করতে চাই কর্মশালায় আগত তরুণ অ্যাডভোকেট দলের কয়েকটি সফলতার গল্প দিয়ে। ময়মনসিংহ ইয়ুথ অ্যাডভোকেট রাব্বি যৌন ও প্রজনন শিক্ষার সংকট কাটিয়ে ওঠার উজ্জ্বল উদাহরণ তুলে ধরেছেন। সাধারণত সব শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে যা ঘটে রাব্বিরও তাই ঘটেছিল। সে যখন মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ে তখন তার স্কুলে শারীরিক শিক্ষার বইটি ভালো করে পড়ানো হয়নি। শিক্ষকরা বয়ঃসন্ধিকালের অধ্যায়টি পড়ানোর সময় বাদ দিয়েছিলেন। ফলে মাধ্যমিক স্কুলের পাট চুকিয়েও তার মনে বয়ঃসন্ধিকাল নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। এমনকি সে দেখেছে তার মতো অনেক শিক্ষার্থীই সেই বিষয়ে পরীক্ষায় প্রশ্ন আসলে সঠিক উত্তর দিতে পারে না বা বাদ দেয়। ব্র্যাকের ইয়ুথ অ্যাডভোকেট প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর যখন অ্যাডভোকেসি শুরু করল, তখন ময়মনসিংহের ইয়ুথ অ্যাডভোকেটদের নিয়ে সে প্রথমে তার নিজের স্কুলে যায়। স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে। এরপর ঐ স্কুলের সকল শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি এসআরএইচআর ক্লাস নেয়। এখন স্কুলটিতে ঐ বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে।
খুলনা ইয়ুথ অ্যাডভোকেটরা ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শের ওপর শিশু-কিশোরদের সচেতন করতে ভিডিও ও পোস্টার তৈরি করতে চায়। তাদের অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম নিয়ে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবদের কাছে যেতে চায়। এজন্য মুন্না ও তার দল ফুলতলা উপজেলার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে সভা করে। সভায় ‘Good Touch, Bad Touch and SRHR’ বিষয়ের ওপর আলোচনা করা হয়। ইয়ুথ অ্যাডভোকেটরা অনুরোধ জানায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যাতে সচেতনতামূলক ভিডিওটি দেখানো হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ ব্যাপারে প্রতিটি স্কুলে চিঠি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
রংপুরের ইয়ুথ অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আবির বলেন, ১৬ ডে অব অ্যাকটিভিজম ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ই ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে এসআরএইচআর বিষয়ে বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটির ৩০০ জন শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রংপুরের ইয়ুথ অ্যাডভোকেটরা প্রতিটি স্কুলে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক পাঠদান নিশ্চিত করার আবেদন নিয়ে রংপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে যায়। তিনি তাদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন এবং প্রতিটি স্কুলে এ বিষয়ে পাঠদান নিশ্চিত করতে একটি চিঠি ইস্যু করেন।