শীলার জন্য

April 2, 2018

শীলা ম্যাগদোলিনাকে চিনতাম ও যখন সিইপি-র ফ্রন্ট ডেস্কে বসে কাজ করত তখন থেকে। ওর স্বাস্থ্য যে খুব ভালো ছিল তা বলা যাবে না। কিন্তু রুগ্ন স্বাস্থ্যের মধ্যেও মুখের কোণে হাসিটা লেগেই থাকত।

আমার গাড়ির রুট নম্বর ১৯। ঐ পথেই যাতায়াত করি। মাঝেমাঝে বিশেষ প্রয়োজনে ফার্মগেট-শাহবাগ-পলাশি রুটের ব্র্যাক স্টাফবাসে যেতাম। বাসে ওঠার পরে গাড়ির বামদিকের দ্বিতীয় সিটে শীলাকে ছেলে অভ্রসহ বসে থাকতে দেখতাম। অভ্রকে নানা কিছু বলে ওর সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু সে আমাকে পাত্তা না দিয়ে তার মাথার ওপরের মিনি ফ্যানটি ঘুরছে কি না বা মায়ের মোবাইলে নির্দিষ্ট গানটি শোনা যাচ্ছে কি না সেদিকেই বেশি মনোযোগী থাকত। আমি হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালিয়েই যেতাম। এভাবে মাঝেমধ্যে যাতায়াতের সূত্রে অভ্র আমাকে অন্তত চিনতে পারত এবং কিছু কিছু কথাবার্তা হত।

শীলা ম্যাগদোলিনাকে চিনতাম ও যখন সিইপি-র ফ্রন্ট ডেস্কে বসে কাজ করত তখন থেকে। ওর স্বাস্থ্য যে খুব ভালো ছিল তা বলা যাবে না। কিন্তু রুগ্ন স্বাস্থ্যের মধ্যেও মুখের কোণে হাসিটা লেগেই থাকত। আমি দেখা হলে মজা করে কিছু একটা বলতাম আর ও দারুণভাবে উপভোগ করে হাসত। ব্র্যাক ডে-র অনুষ্ঠানে ছোট্ট নাটকে যে অংশ নিতাম সে ব্যাপারেও সাধুবাদ জানাতে ভুলত না। যখনই ঐ গাড়িতে যেতাম তখনই লক্ষ করতাম ফার্মগেটে পৌঁছানোর একটু আগে থেকেই শীলার নামার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। দুটি ব্যাগ এবং কোলে অভ্রকে নিয়ে নেমে ওভারব্রিজ পার হত। পশ্চিম দিকে একটু এগোলেই মনিপুরিপাড়ায় ওর বাসা। এভাবে ওকে দেখেছি অনেকদিন।

মাস দুয়েক কিংবা তারও একটু আগে ওকে বলেছিলাম, তুমি আরও রোগা-পাতলা হয়ে গেছ। লক্ষ করলাম, ওর চোখ দুটো আরও ভেতরে ঢুকে গেছে। চেহারার মধ্যে কাহিল ভাব। শুনেছিলাম ইদানীং শরীরটা নাকি ভালো যাচ্ছিল না। আমি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। হঠাৎ খবর পেলাম শীলা ভীষণ অসুস্থ। চিকিৎসা চলছে। ভেবেছিলাম অসুস্থ তো হতেই পারে। অচিরেই সুস্থ হয়ে যাবে। তখনও ভাবিনি যে, শীলার সময় ফুরিয়ে আসছে। ও মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে।

২৯শে মার্চ খবর পেলাম শীলার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে, ওর পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। অসুস্থতা, চিকিৎসা, অপারেশন এবং সর্বশেষ রোগ নির্ণয় সবই জেনেছি। এক সময় ওর মৃত্যু সংবাদ পেলাম। সংবাদ শোনার পরে আমার চোখের সামনে শুধু অভ্রর মুখখানা ভেসে উঠেছে। সারাদিন ডে কেয়ার সেন্টারে কাটানোর পরে গাড়িতে এসে মায়ের কাছে অভ্র যে বায়নাগুলো ধরত, শুধু সে কথাই মনে হয়েছে। আহা, অভ্র মা-হারা হলো?

কমিউনিকেশনসের সুবল দা ছিলেন শীলার সহযাত্রী। শীলার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি খুবই স্মৃতিকাতর এবং বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেলেন। মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, শীলার এভাবে চলে যাওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এই মৃত্যু মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর। দীর্ঘদিন একই গাড়িতে, একই পথে সকাল-সন্ধ্যা দেখা হতো। ওর সঙ্গে কত কথাই না বলেছি। শীলার ছেলে অভ্রর সঙ্গে নানা কিছু নিয়ে মেতে থাকতাম। আমাদের দুজনের আলাপচারিতা শীলা ভীষণ উপভোগ করত। সুন্দর এবং গভীর একটি সম্পর্ক হঠাৎ এভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন।

জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির নিশাত সুলতানা শীলার কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন। বললেন, গত সেপ্টেম্বর থেকে ওর সঙ্গে কাজ করেছি। খুব অল্প সময় ওকে পেয়েছি। প্রয়োজনে যে কোনো ধরনের সহায়তা পেতাম। কাজ দ্রুত শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করত।

নিশাত একটি হলুদ রঙের বল পয়েন্ট দেখিয়ে বললেন, একদিন কলম চেয়েছিলাম। সঙ্গে থাকা কলমটি দিয়ে বলেছিল, এখন এটা দিয়ে লেখেন। পরে নতুন একটা দেব। প্রিন্টার স্পর্শ করে বললেন, এটি কাজ করছিল না। শীলাকে দেখাতেই কী দিয়ে কী যে করল, আমনি চালু হয়ে গেল। আর থামেনি! কিন্তু ওর জীবন থেমে গেল! শেষদিকে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে স্টাফবাসে উঠতে কষ্ট হত। হাবিবভাই খেয়াল করেছিলেন। তিনি শীলাকে বলেছিলেন, এখন থেকে সেকশনের কেউ না কেউ বাসে ওঠার সময় আপনাকে সহায়তা করবে। এ কথা শুনে শীলা হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। ওর দুচোখ বেয়ে শুধু পানি গড়িয়েছে। এসব কথা খুব মনে পড়ছে।

শুনেছি অভ্রর চাইতে দু-তিন বছরের বড় একটি অটিস্টিক সন্তান রয়েছে শীলার। ঘুরেফিরে বারেবারে মনে হচ্ছে, অবোধ শিশু দুটি হয়তো অন্যদের আদর-ভালোবাসায় বেড়ে উঠবে। কিন্তু মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে অন্যরা কী জবাব দেবে? মায়ের জন্য কান্নাকাটি করলে ওদেরকে থামানোর জন্য কী বলবে? অভ্ররা বুঝবে না, এই বয়সে কাকে ওরা হারিয়ে ফেলল। ঈশ্বর, তুমি শীলাকে দেখে রেখো। তুমি তাঁর আত্মার শান্তি দিয়ো এবং দেখে রেখো অভ্র আর ওর ভাইটিকে।

পুনশ্চ : শীলা আর কোনোদিনও স্টাফবাসে যাবে না, অভ্রর সঙ্গেও আর কোনোদিন দেখা হবে না!

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments