মাগো, আমি আসছি…

March 18, 2018

শিউলি ঠিক করল, বাড়িতে গিয়ে খালাম্মাদের এসব কথা মাকে শোনাবে। পাড়ার মেয়েদেরও এসব কথা জানাবে। বাবাকেও সে এসব কথা বলবে। বলবে, মেয়েদের উপর জুলুম করার দিন শেষ হয়ে আসছে। এখন নারীপুরুষ সবাই জেগে উঠছে–আর নারীদের ওপর অত্যাচার চলবে না।

শিউলি পৃথিবীতে আসার আগে পুরো বাড়ি জুড়ে ছিল ভাইয়ের রাজত্ব।

শিউলির জন্ম শহরে নয়, গ্রামে। গ্রামের আলোবাতাসের ছোঁয়ায় ও বেড়ে উঠেছে। শিউলির বাবা খেতমজুর। নিজের জমিজিরাত খুব বেশি ছিল না বলে অন্যের জমিতে কাজ করতেন। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ে ভালোই চলত সংসার।

হঠাৎ এক ঘটনায় ওদের সবকিছু তছনছ হয়ে গেল। শিউলির ছয়-সাত বছরের বড় ভাইটি দুষ্ট বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। আশপাশের দুই-দশ গ্রাম খুঁজেও তার হদিস মিলল না। এই ঘটনার পরে মা পাগলের মতো শুধু এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে ছুটে বেড়ায় আর যাকে কাছে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমরা কি আমার খোকারে দেখছ?’

শিউলির বাবাও ছেলে হারানোর পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেল। কোনো কাজেই মন নেই। আয়-রোজগার প্রায় বন্ধ। পাঁচটি বছর কেটে গেল। সংসার তো আর চলে না। না পেরে পাড়ার এক লোককে ধরে মা শিউলিকে পাঠিয়ে দিল শহরে।

ওখানকার এক বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ নিয়ে শুরু হলো শিউলির নতুন জীবন।

অচেনা শহরে ওকে যে বাসায় রেখে গিয়েছিল গ্রামের ঐ মানুষটি, সেই বাসার রেশমা খালাম্মা নিজের মেয়ের মতোই শিউলিকে বুকে তুলে নিলেন। এ বাড়ির আর সকলের মতো শিউলির জন্য সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন খালাম্মা। খালাম্মার মেয়ে বীথি ওর বন্ধু, সাথি। বয়সে শিউলির চাইতে একটু ছোট বৈ বড় হবে না। যখন বাড়িতে থাকে তখন শিউলিকে নিজের কাছে কাছে রাখে।

ভালোই কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু বেশিদিন কপালে এই ভালো সইলো না। খালাম্মার স্বামী হঠাৎ করে বিদেশে ভালো চাকরি পেলেন। ঠিক হলো, খালুর সঙ্গে পরিবারের সবাই বিদেশে চলে যাবে। কিন্তু শিউলির কী হবে?

খালাম্মা অনেক ভেবেচিন্তে তার এক নিকটাত্মীয়ের কাছে শিউলিকে রেখে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। চলে যাওয়ার আগে রেশমা খালাম্মা শিউলিকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলেন। বীথি শিউলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল অনেকক্ষণ।

নতুন খালাম্মার বাসায় আসার আগে শিউলি খুব চিন্তায় ছিল। নতুন বাসায় কে কী রকম ব্যবহার করবে, কে জানে! কিন্তু দু-একদিনের মধ্যে ভুল ভেঙে গেল শিউলির।

নতুন খালাম্মা একদম আগের খালাম্মার মতো।

খালাম্মার মেয়ের নাম লতা। লতাও শিউলিকে আপন করে নিল বীথির মতোই। খালাম্মা শিউলির জন্য বর্ণপরিচয়ের বই এনে দিয়ে শিউলিকে লেখাপড়া শেখাবার ভার লতাকে দিলেন। শুরু হয় শিউলির ‘অ আ আর ক খ’ চেনার পাঠ। দিনগুলো এগিয়ে যেতে থাকে।

একদিনের কথা। সেদিন সকাল থেকে নতুন খালাম্মা খুব ব্যস্ত। লতা আর শিউলি দুজনকেই তৈরি হতে বললেন। শিউলির খুব কৌতূহল। খালাম্মার কাছে গিয়ে জানতে চায়, ‘আমরা কোথায় যাব?’ খালাম্মা বলেন, ‘আজ ৮ই মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আমাদের মিটিং আছে। সেখানেই যাব।’

খালাম্মার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকের রাস্তার শেষ মাথায় একটি দোতলা বাড়ি। ঐ বাড়ির আঙিনাতেই সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। অনেক লোক সেখানে। মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। খালাম্মার বয়সিরা যেমন আছেন, তেমনি আছে কলেজ ও স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও। খালাম্মা বেশ ব্যস্ত। অন্য নারীদের সঙ্গে কথা বলছেন। মাঝে মাঝে সকলকে বসবার জন্য মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অনুরোধ জানাচ্ছেন।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। প্রথমেই কয়েকজন মেয়ে একই রঙের শাড়ি পরে গাইল: ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’। এরপর বেশ কয়েকজন মঞ্চে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। খালাম্মাও ছিলেন। শুরু হলো বক্তৃতা। এরই মধ্যে একদল মেয়ে এসে শিউলিসহ অন্যদের বুকে বেগুনি রঙের ফিতা লাগিয়ে দিল এবং হাতে পরিয়ে দিল বেগুনি ব্যান্ড। সবকিছু দেখেশুনে শিউলির খুব ভালো লাগছিল।

সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে যা যা বলা হলো সেসব কথা শিউলি আগে কখনও শোনেনি। মেয়েদের ওপর যে নির্যাতন চলছে এবং তাকে রুখতে হলে যে প্রতিবাদ করতে হবে–সে তো খুবই সত্য কথা। ভেতরে ভেতরে শিউলি খুবই উদ্দীপ্ত হলো। একদম শেষে বক্তৃতা করলেন খালাম্মা। খালাম্মাকে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে শিউলি অবাক হয়ে গেল! শ্রোতারা মাঝে মাঝে হাততালি দিচ্ছিল। সমাজ কীভাবে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে বিভেদ চাপিয়ে দিয়েছে, বহুযুগ ধরে নারীদের ওপর কীভাবে নির্যাতন চলছে খালাম্মা সেসব কথা বললেন।

অনুষ্ঠানে বসে বক্তৃতা শুনতে শুনতে শিউলির মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় সে দেখেছে একটু এদিক-ওদিক হলেই তার বাবা মাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে।

কষ্ট হলে এবং ব্যথা পেলেও মা মুখ বুজে কেবলই সহ্য করেছে। গ্রামের অনেক বাড়িতেই একইরকম ঘটনা ঘটতে দেখেছে শিউলি। যারা মেয়েদের গায়ে হাত তুলত তারা মনে করত, শাসন করছে। অনেককে বলতে শুনত, মেয়েদের ঠিক রাখার জন্যই মারধর করা দরকার।

নারীদিবসের বক্তৃতা শুনে শিউলির মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল।

শিউলির মনে পড়ে গেল রেশমা খালাম্মার বাসার একটি ঘটনা। একদিন খালুর সঙ্গে কী নিয়ে যেন খালাম্মার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। ঐ সময় রেগেমেগে খালু এসে খালাম্মার চুলির মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে চড় দেবেন বলে যেই হাত তুলেছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে শিউলি গিয়ে খালাম্মার সামনে দুহাত আগলে দাঁড়িয়ে পড়ল। শিউলিকে দেখে দুজনই অপ্রস্তুত। খালু উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘কী রে, তুই এখন এখানে কেন এসেছিস? কী চাস?’ শিউলি কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে পাশের ঘরে চলে গেল।

দু দিন পর নতুন খালাম্মার কাছে গিয়ে শিউলি বলল, ‘আমারে একটু ছুটি দেন খালাম্মা। আমি বাড়ি যাব।’

খালাম্মা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কেন রে? মায়ের কথা মনে পড়েছে বুঝি?’

শিউলি মাথা নেড়ে শুধু বলে, ‘হ্যাঁ, খালাম্মা।’

কেন যেন বড়ো বেশি করে মায়ের কথা মনে পড়ছে তার। বাবার হাতে মায়ের মার খাওয়ার অনেক ঘটনাই মনে পড়ছে তার।

শিউলি ঠিক করল, বাড়িতে গিয়ে খালাম্মাদের এসব কথা মাকে শোনাবে। পাড়ার মেয়েদেরও এসব কথা জানাবে। বাবাকেও সে এসব কথা বলবে। বলবে, মেয়েদের উপর জুলুম করার দিন শেষ হয়ে আসছে। এখন নারীপুরুষ সবাই জেগে উঠছে–আর নারীদের ওপর অত্যাচার চলবে না।

শিউলি কেবলই ভেবে চলেছে। মায়ের মুখখানি কেবলই তার দুই চোখে ভেসে উঠছে। শিউলির মুখ ফুটে এক সময় শুধু একটি কথাই বেরিয়ে আসে : ‘মাগো, আমি আসছি।’

শিউলি মায়ের কাছে যাচ্ছে। এমন শিউলিদের নিয়েই একদিন গড়ে উঠবে এক সুন্দর পৃথিবী- যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য, কোন নির্যাতন। শিউলিদের দেখাদেখি সকল প্রকার নির্যাতন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক পুরুষরাও, এই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments