মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে ছুটে আসা সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি মানুষকে কলেরার টিকা খাওয়ানোর কার্যক্রম সম্পন্ন হলো। কলেরার টিকা খাওয়ানোর ক্ষেত্রে এই কার্যক্রম বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। প্রথমটি সম্পন্ন হয়েছিল হাইতিতে ২০১৬ সালে।
গত ২৫শে আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এ পর্যন্ত (১৭ই অক্টোবর) প্রায় পাঁচ লাখ ৮২ হাজার মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। দিনের পর দিন পাহাড়-পর্বত ও জঙ্গলঘেরা অতিশয় দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ক্ষুধা-তেষ্টায় কাতর এই মানুষগুলো এসে জড়ো হয়েছেন কক্সবাজারে তাঁদের জন্য নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্র এবং এর আশেপাশে।
কক্সবাজারের দুই উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফে মিয়ানমারের আশ্রয়প্রার্থীদের বড় অংশটি আশ্রয় নিয়েছেন। উখিয়ার কুতুপালং এবং টেকনাফের নোয়াপাড়ায় তাঁদের জন্য সরকারনির্ধারিত দুটি আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থিত। এই দুই আশ্রয়কেন্দ্রে নব্বই দশকের শুরু থেকে আসা মিয়ানমারের আরো নাগরিকরা আগে থেকেই বাস করে আসছেন। তাঁদের সংখ্যা দুই লাখের কম না।
আশ্রয়কেন্দ্র দুটির স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা আগে থেকেই খুব ভালো ছিল না। এরই মধ্যে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এত বিরাট সংখ্যক মানুষ আশ্রয় নেওয়ার কারণে কেন্দ্র দুটির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এ কারণেই মানুষের মধ্যে পানিবাহিত এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বহু গুণ বেড়ে গেছে। কলেরা টিকা খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরুর আগের সাত দিনে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। আর এ কারণেই এই মারাত্মক পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের জন্য সপ্তাহব্যাপী কলেরার টিকা খাওয়ানোর জরুরি কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।
কলেরার টিকা খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরুর জন্য দেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এবং একাধিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সাহায্যে প্রায় নয় লাখ কলেরার টিকা সংগ্রহ এবং ২০০টি ভ্রাম্যমান টিকা খাওয়ানোর দল গঠনের কাজ সম্পন্ন করে। গত ১০ই অক্টোবর থেকে সরকারের নেতৃত্বে টিকা খাওয়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়। ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এ কাজে যুক্ত হয়। সপ্তাহব্যাপী এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ছয় লাখ ৬০ হাজার জনেরও বেশি মানুষকে এই টিকা খাওয়ানো হয়। ব্র্যাকের ৩০ জন কর্মী এতে সরাসরি জড়িত থেকে লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ অর্জনে অবদান রাখেন।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিচালক ডা. কাওসার আফসানা বলেন, ‘শুধুমাত্র অংশীদারদের বিপুল সহযোগিতা ও নিবিড় সমন্বয়ের জন্যই এত বৃহৎ পরিসরে এই কর্মযজ্ঞ সফল করা সম্ভব হয়েছে।’
অতীতে বাংলাদেশে ডায়রিয়া প্রতিরোধ কার্যক্রমকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্র্যাকের ব্যাপক অভিজ্ঞতার কথা সর্বজনবিদিত। গাঙ্গেয় অববাহিকায় অবস্থিত বঙ্গীয় বদ্বীপ ডায়রিয়া ও কলেরা জাতীয় রোগের আদি উৎস। এই রোগে একসময় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) ডায়রিয়া প্রতিরোধে যে খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবন করে তা তৈরির পদ্ধতি মাঠপর্যায়ের নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রমে ব্র্যাক সম্পৃক্ত হয়। ১৯৮০’র দশকে বাংলাদেশ সরকার, আইসিডিডিআর,বি এবং ব্র্যাক কর্তৃক গৃহীত সেই যৌথ উদ্যোগের আওতায় ব্র্যাকের কর্মীরা দেশের লাখ লাখ পরিবারের দোড়গোড়ায় পৌঁছে মায়েদের নিরাপদ পানি, গুড় ও লবণ সহযোগে খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করার পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য কার্যক্রমে সরকার ও বেসরকারি সংগঠনের মধ্যে সহযোগিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই কার্যক্রম। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আজ ডায়রিয়া ও কলেরা জাতীয় রোগকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু আজ বিরল ঘটনা।
১৯৮০ সালের দিকে ব্র্যাক সরকারের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির কাজেও সহযোগিতা করে। সেসময় টিকা দেওয়ার হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তী চার বছরে এই হার ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়।
কক্সবাজারের উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ে ব্র্যাকই সবচেয়ে বড় পরিসরে কাজ করছে বলা যায়। সেখানে বর্তমানে আমাদের ৭০০ জনের বেশি কর্মী মিয়ানমারের নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এখন সেখানে ব্র্যাকের ৫০টি ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্য ক্যাম্প ও ১০টি স্থায়ী স্বাস্থ্য ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে এবং চিকিৎসক, ধাত্রী ও প্যারামেডিকের সহায়তায় ১২০ জনের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিদিন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মিয়ানমার থেকে আগতদের রোগ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ডা. আফসানা আরও বলেন, ‘এমন একটি জরুরি পরিস্থিতিতে এখানকার সার্বিক স্বাস্থ্যচিত্র সম্পর্কে নিবিড় উপাত্ত সংগ্রহের ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আমাদের নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত উঠে এসেছে। আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের উৎস হিসাবে কাজ করছে।’
নভেম্বরের শুরুতে কলেরার টিকা খাওয়ানো কার্যক্রমের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। এর আওতায় ১-৫ বছর বয়সি দুই লাখ ৫০ হাজার শিশুকে টিকা খাওয়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের ডাকে ব্র্যাক এ কার্যক্রমে আরও বিস্তৃত ও নিবিড়ভাবে সাড়া দিতে প্রস্তুত, ঠিক যেমনটি আমরা গত ৪৫ বছর ধরে করে আসছি।