ছোটো ছোটো
গল্পগুলো

July 17, 2019

তিনি কিছুদিন আগে ব্র্যাক থেকে বাড়ি তৈরির জন্য সত্তর হাজার টাকা ঋণ পেয়েছেন। এত টাকা ঋণ নিয়ে একজন নারী বাড়ি বানাচ্ছেন সেটা ঐ গ্রামের বাসিন্দাদের কল্পনার বাইরে!

‘অহন আর ওই দিন নাই স্যার। অহন মোগো স্বামী মোগো ঢাহাত যাইতে দেবো। ট্রেনিং করবার দেবো। সংসারে তার লগে আমিও কামাই করি। সে তো মহা খুশি।’ কথাগুলো বলেছেন ফরিদা বেগম। একসময় তার সংসারে অভাব ছিল। এখন স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাল ধরেছেন সংসারের। যখন কেনো উদ্যোগ সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে আনে, তখন বলা যায় সেটি অবশ্যই মহৎ।

নিজের কথা

ব্র্যাকে আমার যাত্রা এই বছর এপ্রিলের সাত তারিখ থেকে শুরু হয়েছে। জীবনের নতুন এই অধ্যায় শুরু করতে আমি পেছনে ফেলে এসেছি ক্রীড়া সাংবাদিকতার নয় বছরের পরিশ্রম। কর্মসূচির কার্যক্রমকে ভালোভাবে জানার জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। সুতরাং জীবনযুদ্ধে সফল নারীদের গল্পগাথা সংগ্রহ করার জন্য আমি রওনা হলাম ভোলার দিকে।

ফিল্ড ভিজিটে একদিন

ভোলার দৌলতখান উপজেলা, উত্তর জয়নগর ইউনিয়নে মধ্যজয়নগর গ্রামে গেলাম। সেখানে গিয়ে ফরিদা বেগমের কথা জানলাম। তার বয়স ৩৮ বছর। মধ্যজয়নগরে তাকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকেই চেনেন। তিনি কিছুদিন আগে ব্র্যাক থেকে বাড়ি তৈরির জন্য সত্তর হাজার টাকা ঋণ পেয়েছেন। এত টাকা ঋণ নিয়ে একজন নারী বাড়ি বানাচ্ছেন সেটা ঐ অজ পাড়াগাঁয়ে এখনও অনেকে ভাবতে পারে না। কথায় কথায় আমার সহকর্মী ফরিদা বেগমের সংগ্রামময় জীবনের গল্প খানিক বললেন। একসময় দিনমজুরের কাজ করতেন তার স্বামী শাজাহান। একজনের আয়ের ওপরই নির্ভর ছিল ফরিদার সংসার। স্বামী দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন কিন্তু তারপরও সংসারে রয়েছে অভাব, পরিবারে মিলছে না তিনবেলার আহার।

মানুষের পাশে

আমি ফরিদা আপার সঙ্গে দেখা করলাম। জানতে চাইলাম, ব্র্যাকের সঙ্গে পরিচয় হলো কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ফরিদা আপা বললেন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকেই প্রথম ব্র্যাকের কথা জানি। আমি শুনেছিলাম যারা অনেক গরিব ও অসহায় তাদেরকেও সহায়তা করে ব্র্যাক। এছাড়াও ব্র্যাক থেকে টাকা ধার নেওয়া যায়। প্রতি সপ্তাহে একটু একটু  করে তা পরিশোধের সুবিধা আছে। সুস্থ জীবন, শিক্ষা, সঞ্চয়, আইনি শিক্ষা ও সহায়তা, ন্যায্য অধিকার আদায়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানা কর্মকান্ড ব্র্যাক পরিচালনা করে। ব্র্যাক গ্রামবাসীদের নিয়ে গড়ে তোলে গ্রাম সংগঠন। এর সদস্যরা সপ্তাহে একদিন বৈঠকে মিলিত হয়। একে অন্যের সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলে। সুতরাং সবদিক বিবেচনা করে ভালো কিছুর আশায় তিনি ২০১৫ সালে ব্র্যাকের গ্রাম সংগঠনের সদস্য হয়ে যান।

ঘুরে যায় জীবনের গল্প

গ্রাম সংগঠনের সদস্য হবার পর ফরিদা আপার সংসারের অবস্থা বিবেচনা করে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচি। এরপর কর্মসূচি থেকে তাকে একটি গরু ও একটি ছাগল বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এই গরু আর ছাগল হলো তার আয়ের উৎস। বছর ঘুরতেই বাচ্চা দিল ছাগল। সেই ছাগলের বাচ্চা বড়ো হবার পর বিক্রি করে এর কিছু অংশ দিয়ে স্বামীকে ভ্যান গাড়ি কিনে দেন।

স্বামী ভ্যান চালিয়ে আয় করে, গরু-ছাগল বিক্রি করেও কিছু টাকা সঞ্চয় করে ফরিদা। প্রতি সপ্তাহে অল্প অল্প করে ব্র্যাকেও টাকা সঞ্চয় করেন তিনি। সব সঞ্চয়ের টাকা মিলিয়ে পাঁচ কাঠা জমি কিনেছেন।

এরমধ্যে পুকুরে মাছ চাষও শুরু করেছেন। ব্র্যাক থেকে ব্যবসার জন্য প্রথমে পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নেন, তারপর বিশ হাজার টাকা। যথাসময় পুরোটা পরিশোধ করে এবার তিনি নিয়েছেন সত্তর হাজার টাকা। চার ছেলে ও স্বামী-স্ত্রী মোট ছয় জনের সংসার তার। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেও তিনি ব্র্যাকের সহযোগিতা পেয়েছেন। তার বড়ো ছেলে পড়ালেখা শেষ করে এখন বরিশালে চাকরি করছেন। চাকরির টাকা থেকে কিছু অংশ সে মাকে দেয়। সুতরাং ফরিদা বেগমকে আর পেছনে তাকাতে হচ্ছে না। সংসারের অভাব ঘুচেছে, সুখ-শান্তি ফিরে এসেছে জীবনে।

স্বাধীনতা আমার, সিদ্ধান্তও আমার

আমি আগ্রহ নিয়ে তার সব কথা শুনলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম, অনেক কিছু তো হলো। এখন যদি আরও উন্নত ভবিষ্যতের জন্যে ব্র্যাক আপনাকে ঢাকায় প্রশিক্ষণ নিতে বলে, স্বামী কি রাজি হবেন? তার উত্তরে কিছুটা বিস্মিত হলাম। ভোলার দৌলতখান উপজেলার ছোট্ট গ্রাম মধ্যজয়নগরের আত্মপ্রত্যয়ী এই নারী বেশ সাবলীলভাবে জানালেন, প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য স্বামী খুশি মনেই ঢাকা যেতে দেবেন। বুঝলাম সংসারে তাদের বোঝাপড়াটা ভালো। সিদ্ধান্তগ্রহণে তার বাধা নেই। তিনি কী করবেন তা নিজেই ঠিক করেন।

উপলব্ধি

ছেলেবেলায় দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে রূপকথার গল্প শুনতাম। ফরিদা আপা আমার কাছে তেমনই একজন। যার কাহিনি কল্পনাকেও হার মানায়। বাস্তব জীবনের নায়ক তো তারাই। তিনি যেন প্রমাণ করে দিলেন, সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে যে কেউ তার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে।

ওই গ্রামে দিনকে দিন বাড়ছে ফরিদা বেগমদের সংখ্যা। ওদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে ব্র্যাক। ব্র্যাকের হাত ধরে বদলে যাচ্ছে অনেক অনেক ফরিদার জীবন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments