আবেদ : মানবতার কল্যাণে উৎসর্গিত জীবন

December 20, 2023

সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা তাঁর জীবনদর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং তাঁকে রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষে। আবেদ তাঁর সমগ্র জীবনই মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করেন এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যান।

আমার জানা মতে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যারা বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ফজলে হাসান আবেদের চেয়ে বেশি কিছু করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ব্র্যাক নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে নানা সেবা পৌঁছে দিয়েছে। আবেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে ব্র্যাকের কার্যক্রম বিশ্বের নানা দেশে বিস্তৃত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা যেমন : শ্রীলংকায় সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষদের জন্য কাজ করেছে ব্র্যাক। ব্র্যাক বর্তমানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য বড় পরিসরে কাজ করছে। এ ছাড়া এর কার্যক্রম চলমান রয়েছে পাকিস্তান, ফিলিপাইন, তানজানিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া এবং সিয়েরা লিওনে। ব্র্যাক আটলান্টিকের ওপারে হাইতিতেও পৌঁছে গিয়েছে।

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া ব্র্যাক আজ বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। এর বাৎসরিক বাজেটের পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি এবং এখানে লক্ষাধিক কর্মী কাজ করছেন। ব্র্যাকের অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি যেকোনো কর্মসূচিই বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়ন করতে পারে। এতে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ পায়। এখন এটি কেবল একটি বেসরকারি সংস্থা নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। এটি বর্তমানে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে। এর সাংগঠনিক কাঠামো এবং গ্রহণযোগ্যতা অক্সফামের মতো বিশ্বের প্রথম সারির আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাতারে। তা ছাড়া ব্র্যাকের নানা কার্যক্রমের কথা বিশ্বের সেরা বিজনেস স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কেসস্টাডিগুলোতেও উঠে এসেছে। বর্তমানে ব্র্যাকের রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি, যা থেকেই পুরো প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ বাজেটের সংস্থান হয়। ব্র্যাক ব্যাংকের মতো সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক বাণিজ্যিক উদ্যোগে বিনিয়োগের মাধ্যমে সংস্থাটির মূলধন বেড়েছে। এর ফলে ব্র্যাক এখন নানা কর্মসূচি আরও বিস্তৃত পরিসরে বাস্তবায়ন করতে পারছে এবং বেশিসংখ্যক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে নানা সেবা পৌঁছে দিচ্ছে।

সমাজের এত বেশিসংখ্যক মানুষের জন্য বিস্তৃতভাবে কাজ করা সম্ভব হয়েছে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের কর্মতৎপরতা এবং দূরদর্শিতার কারণে। আবেদের ছিল অনন্য সাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা। সেইসঙ্গে মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা তাঁকে নিজ দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং সময়ের পরিক্রমায় তা পৌঁছে গেছে বিশ্বের নানা প্রান্তের অধিকারবঞ্চিত মানুষের কাছে। আবেদের চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল একটি বেসরকারি তেল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে। এরপরে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত যেমন : সত্তরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা তাঁর জীবনদর্শনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং তাঁকে রূপান্তরিত করে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষে। আবেদ তাঁর সমগ্র জীবনই মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করেন এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যান। সমাজের অধিকারবঞ্চিত মানুষের পাশাপাশি যারা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে অবিচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

প্রফেসর রেহমান সোবহানের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ

বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আবেদ উন্নয়নের নতুন একটি ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছেন, যার মাধ্যমে বাংলাদেশে সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোকে একত্র করে উন্নয়নের একটি সমন্বিত ধারণাকে প্রচার করেছেন, যাতে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীও স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পায়। এভাবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদেরকে আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মপ্রতিষ্ঠিত করার ধারণাকে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি এখন বিভিন্ন দাতা সংস্থার অনুদানের ওপর আর নির্ভরশীল নয়, বরং নানা আয়বর্ধনমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেই এর বাজেটের ব্যবস্থা করে নিতে পেরেছে। ব্র্যাকের এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয় বরং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জন্য তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। এ সকল উদ্যোগ এবং কর্মকাণ্ডের কারণে আবেদ ও ব্র্যাক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। বিশ্বের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্যার ফজলে হাসান আবেদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

আবেদ তাঁর জীবনের ৪৫টি বছর দেশের এবং দেশের বাইরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ব্যয় করেছেন। তাঁর মহানুভব ব্যক্তিত্ব এবং প্রচারবিমুখতার কারণে তিনি তাঁর কৃতিত্বের কথা জোরেশোরে বলার চাইতে কাজ করে যাওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। জীবনের ৮০তম বর্ষে পদার্পণ করেও মানুষের জন্য কিছু করার ব্যাপারে তাঁর উদ্যম এতটুকু কমেনি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিস্তৃত পরিসরে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে নানা সেবা পৌঁছে দিতে তিনি এখনও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আবেদ কখনই এর সমাপ্তি টানতে চান না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি দেশের ও দেশের বাইরের এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জীবনে সত্যিই কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারছেন। আবেদ যেন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের জন্য কল্যাণকর আরও অনেক কিছু করার শক্তি ও প্রয়াস পান, এই প্রার্থনা করি।

 

 লেখক : অর্থনীতিবিদ, চেয়ারম্যান-সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) 

মূল ইংরেজি লেখাটি ২০১৬ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর ৮০তম জন্মবার্ষিকীর সংবর্ধনাগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল

অনুবাদ : সাব্বির আহমেদ ইমন

3.5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Md:Raihan Ali
Md:Raihan Ali
3 months ago

Nice