মানব পাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন রহিমা (ছদ্মনাম)। তার অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দুঃখজনক ঘটনার জের টানছিলেন অনেকদিন ধরে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে যেন তিনি বের হয়ে আসতে পারেন, সেজন্য একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেন কাউন্সেলর। জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণের ধারণা পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে তিনি তার সাহস ফিরে পেতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি উদ্বেগ এবং মানসিক চাপের বোঝা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন।
আর্থিক টানাটানি কিছুটা থাকলেও ৪০ বছর বয়সী রহিমা (ছদ্মনাম) স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু যেন সবকিছু ওলটপালট করে দিল। এরপর থেকে একে একে নানা খারাপ সময়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন নারী, এমনিতেই জীবনে চ্যালেঞ্জের কোনো শেষ থাকে না, এর সাথে তার জীবনে যোগ হয়েছিল সন্তানদের সবার মুখে আহার জোগানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব। তাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না।
সিলেটের মেয়ে রহিমা। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তাই অল্প বয়সেই তাকে এক দিনমজুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। সেখানে টানাটানি থাকলেও স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক ছিল ভালো। একে একে তাদের পরিবারে আসে তিন সন্তান।
স্বামীর মৃত্যুর পর শুরু হয় দুঃসময়। কঠিন সেই সময়ে আত্মীয়স্বজনকে পাশে পাবার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি, তখন স্বামীর পরিবার, এমনকি বাবার বাড়ির পরিবারও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বাধ্য হয়ে তিনি আশ্রয় নেন তার এক চাচাতো বোনের বাড়িতে।
এক দালালের যাতায়াত ছিল সেখানে। দালাল কথাবার্তা বলে সবার কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। রহিমা কষ্টে আছে, একেই সে কাজে লাগায়। সৌদি আরবে ভালো বেতনে গৃহকর্মী হিসেবে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। আর্থিক ও মানসিক নানা সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার এটা একটা ভালো সুযোগ, তাই রহিমা রাজি হয়ে যান।
২০২১ সালের ৮ই অক্টোবর তিনি পাড়ি দেন সৌদি আরবে। সেখানে যাওয়ার পরপরই নিয়োগকর্তা শুরু করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। পাসপোর্ট আটকে রাখে, ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া দেয় না। এমনকি সম্পূর্ণ বিনা বেতনে কাজ করতেও বাধ্য করে।
২০২৩ সালের ২৪শে জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন রহিমা। সাথে করে টাকা-পয়সা কিছুই আনতে পারেননি। ফেরার পর বেকার জীবনের কঠোর বাস্তবতা আর বিদেশে সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা মনে করে বারবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন।
এ সময় তিনি অত্যধিক উত্তেজনা, ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন, মনযোগহীনতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং হতাশার সাথে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। এরপর তিনি ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের একজন মনোসামাজিক কাউন্সেলরের সহায়তা পান।
মানব পাচার ও নির্যাতনের শিকার রহিমার অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া নানা দুঃখজনক ঘটনা এবং তার চলমান সমস্যাগুলোর কথা যেন তিনি যথাযথভাবে বলতে পারেন সেজন্য একটি নিরাপদ এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে দেন কাউন্সেলর। প্রকৃত সহানুভূতির সঙ্গে তিনি রহিমার সব কথা শোনেন।
রহিমার মানসিক ও আর্থিক সংকট মূল্যায়ন এবং সম্ভাব্য সমাধান অন্বেষণে সহায়তা করেন কাউন্সেলর। জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণের ধারণা পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে রহিমা তার সাহস ফিরে পেতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি উদ্বেগ এবং মানসিক চাপের বোঝা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। তিনি মোট ২টি দীর্ঘ কাউন্সেলিং সেশনে অংশগ্রহণ করেন, যা তার চিন্তার জগতের পরিবর্তন ও আত্ম-উপলব্ধি সৃষ্টি করতে সহায়তা করে।
বর্তমানে রহিমা একজন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছেন, মাসিক আয় ৩০০০ টাকা। এখন তিনি একটি সেলাই মেশিন কিনে সংসারের আয় বৃদ্ধি করতে চান। এ জন্য তার প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা।
অসীম প্রতিকূলতার মধ্যেও কাউন্সেলিং যে ভূমিকা পালন করতে পারে রহিমার ঘুরে দাঁড়ানো তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি তার অতীত অভিজ্ঞতার শিকল থেকে মুক্ত হতে নিজের এবং তার পরিবারের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ৷
(বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস ২০২৩-এর এবারের প্রতিপাদ্য, ‘পাচারের শিকার সকলের পাশে থাকব, বাদ যাবে না কেউ।’)
Interesting!!!