“না গেলে বোঝা যায় না কেমন দুর্গম এলাকা। বর্ষা মৌসুম, নৌকার মৌসুম। পাল তুলে নিজে হাল ধরে দাঁড় বেয়ে চলার কী যে আনন্দ! আজ এখানে বসে ভাবছি, গাড়ি চড়ে পথচলা কি তেমনই আনন্দের? তাহলে শহরের পথে গাড়িতে বসে তেমন করে মন মেতে ওঠে না কেন? শুকনো মৌসুমে একমাত্র উপায় ছিল পায়ে হেঁটে চলা।”
মো. মোয়াজ্জেম হাসান
মো. মোয়াজ্জেম হাসান ১৯৭২ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি ব্র্যাকের মাঠ পর্যায়ের প্রথম কর্মী হিসেবে সুনামগঞ্জের শাল্লার দিরাই ক্যাম্পে যোগদান করেছিলেন। যোগদানের কিছুদিন পরেই তাঁকে হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে মার্কুলী ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ব্র্যাকের শুরুর দিকের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
১৯৭৭ সালে ব্র্যাকের প্রথম সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ ‘ব্র্যাক প্রিন্টার্স’-এর কার্যক্রম শুরু হলে তাঁকে সেখানে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর প্রায় ৩০ বছর তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালে ব্র্যাক থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি ‘ব্র্যাক প্রিন্টার্স’-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ব্র্যাকের প্রথম নিজস্ব ভবন ৬৬ মাহখালী, ঢাকা-১২১২ তে নিচতলায় ছিল ব্র্যাক প্রিন্টার্স। ভবনের বাইরে তার সাইনবোর্ড
১৭ই মে ২০২১ তারিখ সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকাস্থ একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি করোনাভাইরাস পজিটিভ ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, ১ ছেলে, ২ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ব্র্যাক পরিবারের পক্ষ থেকে আমরা তাঁর মৃত্যুতে শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
মোয়াজ্জেম হাসান-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ব্র্যাকের অভ্যন্তরীণ মুখপাত্র ‘সেতু’-র জুলাই ১৯৮৬, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যায় তাঁর লেখা ‘মাটির বাঁধ না ভালোবাসার বাঁধ’ এবং ২৫ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যায় তাঁর লেখা ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মো. মোয়াজ্জেম হাসান
জিএম-ব্র্যাক প্রিন্টার্স
১৯৭২ সাল। চাকরি পেলাম। দিরাই গেলে হুকুম হলো মার্কুলি ক্যাম্পে যাওয়ার। কিন্তু ক্যাম্প কোথায়? আশ্রয় নিতে হলো এক মুদির দোকানে–স্যাঁতসেতে মেঝেয় শুয়ে কাটালাম দু’রাত। তারপর স্থানীয় লোকদের সহায়তায় আশ্রয় পেলাম পরিত্যক্ত ওয়ারলেস গুমটি ঘরে। সকালে উঠেই বেরোতে হয় কাজে। ফিরে আসি সন্ধ্যায়–নাওয়া-খাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
দিন তারিখ আজ আর মনে নেই তবুও ভুলি নি–সেদিন ফিরেছিলাম একটু বেলা থাকতেই। ঘরের দরজা খুলতেই চমকে উঠলাম সাপের ফণা দেখে। হলে কী হবে–ঘাবড়ালাম না। ব্যবহার করলাম হাতের স্কেল। মারলাম এক এক করে আঠারোটি জাত সাপের ছানা। ঠিক সন্ধ্যা হয় হয়। শহীদ সাহেব ফিরছেন–একটা সাপ মাড়িয়ে দেখলেন আমার সাজানো মরা সাপগুলো। দেখে চিৎকার করে দৌড় দিলেন। ওনার চিৎকারে দৌড়ে এলো অনেক লোক। আজ ভাবতে পারি না সেই পরিবেশের কথা। কেমন করে সব ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে জাগরূক ছিল আমাদের উন্নয়নের চেষ্টা।
সেই এক রাত। আমাদের নবগঠিত ক্যাম্পে শুয়ে আছি। বিছানা ভেজা ভেজা ঠেকছে। অন্ধকারে ঘুমের ঘোরে বিছানায় এদিক ওদিক হাতড়ে দেখছি। হাত পড়লো একটা ব্যাঙের ওপর। লাফ দিয়ে পড়ল পানিতে। ঘরের মেঝেতে চৌকি সমান পানি।
বন্যার পানিতে চারিদিক টই টম্বুর। বৃষ্টির মাতামাতি। চোখ খুললে দেখা যায় শুধু বড় বড় ঢেউ। আবেদ ভাই বিষণ্ন চিত্তে বসে আছেন আর মাঝে মাঝে নিজের মনেই বলছেন, ক্যাম্পগুলোর খবর পাওয়া গেল না আজ তিনদিন। আবেদ ভাইয়ের মনের কথা আমার মনে নাড়া দিল। ভুলে গেলাম বিপদের কথা। স্পিডবোটে উঠলাম। সাথী হলো করিম সাহেব আর মোসলেম মিঞা। গেলাম ক্যাম্পগুলোতে। ফিরছি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চলে এসেছি প্রায় মার্কুলিতে। হঠাৎ বিকল হয়ে গেল কলের নৌকা। ভেঙে গেছে প্রপেলারের পিন। স্রোতের টানে আর ঝড়ের দাপটে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। আর সেই নৌকাতেই আমি মেরামত করছি নৌকার কল। মেরামত হলো, ফিরে এলাম মার্কুলিতে। আবেদ ভাই আর ইকবাল ভাইয়ের উদ্বেগ কেটে গেল। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাদের মুখ। বললেন, ‘স্পিডবোটের শব্দ কানে শোনার পরও যখন এক ঘণ্টার ওপর তোমরা এলে না তখন ভাবলাম হয়তো কোনো বিপদ হয়েছে। আর কিছুক্ষণ পরেই আমরা বের হতাম তোমাদের সন্ধানে।’ শুনে আমার বুকটা ফুলে উঠল গর্বে, অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলাম তাদের ভালোবাসা।
সদ্যস্বাধীন দেশে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ভিটেয় ঘর নির্মাণের জন্য ভারতের আসাম থেকে নদীপথে বাঁশ ও কাঠের গুঁড়ি আনা হয়েছিল বিশাল ভেলা বানিয়ে (১৯৭২ সাল)
পুনর্বাসনের জরিপ কাজ প্রায় শেষ। ঢেউটিন এসে গেছে। আবেদ ভাই মার্কুলিতে। যাবেন প্রোজেক্ট এরিয়ার বাইরে এক গ্রামে। সঙ্গী হয়েছি আমি আর রফিক ভাই। স্পিডবোট চালাচ্ছি। অচেনা পথ। মাঝপথে এমন এক জায়গায় এসে পড়েছি যেখানে পানির ওপরে কচুরিপানা আর নিচে কাঁটাচার বনে আটকে স্পিডবোট আর চলে না। বললাম ‘আর বোধহয় যাওয়া যাবে না।’ আবেদ ভাই শুধু বললেন, ‘যাওয়ার দরকার ছিল।’ কোনো আদেশ নয়, অনুরোধ নয় কিন্তু এ যেন এক সম্মোহনী শক্তি, যা আমাকে নিয়ে চলল কচুরিপানা সরিয়ে আর প্রপেলারের জট ছাড়িয়ে পৌঁছে দিল অভিষ্ট লক্ষ্যে। কীসের প্রভাবে আমরা অসাধ্য সাধন করলাম আজও তা ভাবি।
ফিরছি অন্য পথে। উদ্দেশ্য দুটো–কচুরিপানা এড়ানো আর খালের পাড়ের কয়েকটি গ্রাম আবেদ ভাইকে দেখানো। দেখলাম ঘরছাড়া গ্রামগুলো। আমার কথা শুনলেন আর সঙ্গেসঙ্গে দায়িত্ব পড়ল আমারই ঘাড়ে। বজ্রপাত হলো আমার মাথায়। জরিপ না করে কীভাবে টিন দেব? ঝুঁকি নিলাম। গ্রামের লোকদের বললাম জরিপ করার সময় নেই কিন্তু ৫০টি ঘরের উপকরণ দিতে চাই। আপনারা ঠিক করুন কাদের দিতে হবে। জনসাধারণ ক’দিন পরেই যে তালিকা দিল পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেই তালিকাই সবচাইতে নির্ভুল জরিপ।
আমি বুঝতে পারলাম সাধারণ মানুষের হাতে পরিকল্পনার ভার ছেড়ে দিলেই সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব।
স্মৃতির পাতা উল্টালে চোখের ওপর ভেসে উঠে মার্কুলি-দৌলতপুরের বাঁধ। মনে হয় এ যেন মাটির বাঁধ নয়, ভালোবাসার বাঁধ। আমরা বোধ হয় নিজকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলাম মার্কুলি-দৌলতপুরের মানুষের সঙ্গে, একাত্ম হয়ে দেখতে পেরেছিলাম তাদের সমস্যা, সমাধানের উপায় খুঁজেছিলাম সবার সাথে এক হয়ে। তাই তো সেদিন এলাকাবাসী কোদাল ধরেছিল আমাদের সাথে এক হয়ে–তৈরি করেছিল সেই ভালোবাসার বাঁধ যা আজও আছে, থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে।
মো. মোয়াজ্জেম হাসান
পরিচালক-ব্র্যাক প্রিন্টার্স
এই তো সেদিন। সদ্যসমাপ্ত সুন্দর, সুসজ্জিত ব্র্যাক সেন্টারের উনিশতম তলায় আমরা অপেক্ষমাণ। আর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে আমাদের আলোচনাসভা। দৃষ্টি মেলে দিয়েছি বাইরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিকে। হঠাৎ করে মনের মণিকোঠায় ভেসে উঠল অতীত দিনের স্মৃতি। ১৯৭২-এর ব্র্যাক, মার্কুলির ব্র্যাক আর আজকের এই ১৯৯৬-এর মহাখালীর ব্র্যাক। সেদিনের কনফারেন্স আর আজকের কনফারেন্স! আবেদভাই আমাদের নিয়ে বসতেন মার্কুলিতে, টিনের চালা, টিনের বেড়ার ঘর। চিন্তাভাবনা বানিয়াচং, শাল্লা আর দিরাইয়ের উন্নয়ন–নিঃস্ব আর অসহায় মানুষের উন্নয়ন।
দুর্গত, দুর্গম এই এলাকায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার ছাপ মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় পোড়াভিটার ওপর টিনের চালা তুলে দেওয়ার কাজ সবে শেষ হয়েছে। টিনের চালে রোদ পড়ে ঠিকরে ওঠে আলো। সেই আলোয় মন ভরে যায় আত্মতৃপ্তিতে। মনে হয় কষ্ট সফল হয়েছে। কিন্তু হায়, টিকল না সেই রৌদ্রোজ্জ্বল আলো। আমরা দেখলাম, ভিটেয় টিন নেই, বিক্রি হয়ে গেছে তাদের কাছে, যাদের আছে।
মনে সান্ত্বনা, আবেদভাই পুনর্বাসনের পথকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন পুনর্জাগরণের পথে। এই এলাকাতেই কাজ হবে, তবে ভিন্ন পথে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক উন্নয়নের পথে। পুনর্বাসনের কাজ শেষ হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেল রিলিফ দিয়ে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করা যায় না, এর জন্য চাই হাতে-কলমে শিক্ষা, চাই মডেল।
সহকর্মীদের সঙ্গে ব্র্যাকের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। অন্যদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত রয়েছেন মোয়াজ্জেম হাসান (বাঁদিক থেকে প্রথমজন)
কীভাবে ত্বরান্বিত করা যায় উন্নয়নের কাজ, তা নিয়ে আবেদভাই বসতেন পনের দিন পরপর মার্কুলিতে। একের পর এক যুক্তির অবতারণা হতো, সিদ্ধান্ত হতো অবশেষে। এলাকায় থেকে উন্নতির অন্তরায় খুঁজে বের করে সমস্যা সমাধানের উপায় চিহ্নিত করা, এলাকাবাসীদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করা, এলাকার উন্নয়ন করা। ব্যবহারিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যশিক্ষা, সমবায় গড়ে যৌথভাবে উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এমনই এক মিটিংয়ে আমি প্রস্তাব করলাম, প্রকল্প এলাকায় ১১টি ক্যাম্পে প্রতিটিতেই গড়ে তুলতে হবে একটি করে আদর্শ খামার, যে-খামারে হবে উচ্চফলনশীল ধানের চাষ, পাশাপাশি থাকবে শাকসবজির বাগান। আমার প্রস্তাব গৃহীত হলো, আমি তখন ছিলাম মার্কুলি থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে কাগাপাশা ক্যাম্পের এরিয়া ম্যানেজার। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, নবজীবনের কিছু পদচিহ্ন রেখে যেতে হবে।
অঙ্গীকারে দৃপ্ত, উদ্দীপ্ত কর্মপ্রেরণায় এমনিই একদিন ক্যাম্পের পাশে প্রায় এক বিঘা জমি জুড়ে চাষ আরম্ভ করলাম সবজির–ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, শালগম, টমেটো, লেটুসপাতা, যা কখনও হয় নি এসব এলাকায়।
আমাদের প্রচেষ্টা সফল হলো–আশেপাশের লোকজন এসে দেখতে লাগল, আমাদের বাগান। তারা ভাবত, বিএ; এমএ পাশ এই ছেলেরা কোদাল চালায়, জমি চাষ করে! অবাক হতো তারা। প্রখব রৌদ্রে শরীর থেকে ঘাম ঝরছে অবিরাম, তবু মনে গর্ব অনুভব করতাম, ইতিহাস গড়ছি। এখন ভাবি, পেরেছি কি ইতিহাস গড়তে? এখন নিজের কাছেই অবাক লাগে কেমন করে এত অল্প সময়ে সম্ভব হয়েছিল সেসব দিনের কাজ।
না গেলে বোঝা যায় না কেমন দুর্গম এলাকা। বর্ষা মৌসুম, নৌকার মৌসুম। পাল তুলে নিজে হাল ধরে দাঁড় বেয়ে চলার কী যে আনন্দ! আজ এখানে বসে ভাবছি, গাড়ি চড়ে পথচলা কি তেমনই আনন্দের? তাহলে শহরের পথে গাড়িতে বসে তেমন করে মন মেতে ওঠে না কেন? শুকনো মৌসুমে একমাত্র উপায় ছিল পায়ে হেঁটে চলা। সাথে গামছা থাকত একখানা। নদীনালা পাড়ি দিতাম গামছা পরে সাঁতার কেটে।
সেদিনের কথা ভেবে অবাক লাগে আমারই। মুসলিম আর আমি সেদিন কীসের উন্মাদনায় জীবনপণ করে আলিমপুর গেলাম–পাম্প বসালাম। কিন্তু বসিয়েছিলাম, সে তো সত্যি। আলিমপুর। আলিমপুরে ইরি ধানের ক্ষেত করেছি আমরা। কাগাপাশার গুগরাপুর। গুগরাপুরে আমাদের ক্যাম্প। আর ক্যাম্প থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আলিমপুরে ইরি ধানের মিনি খামার–আদর্শ খামার। শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না, তাই ফসল হয় না। দিনের পর দিন মোটিভেশন চালিয়ে এলাকার জনগণকে বোঝাতে পেরেছি, ভালো ফলন পাওয়ার জন্য দরকার ইরি বীজ। ইরি ক্ষেতে দরকার পানি। পানির জন্য দরকার পাম্প। পাম্পের সুবিধা বুঝে লোকজন চেয়েছে পানি সেচের সুবিধা নিতে। বুঝিয়েছি, পাম্প হলেই তো চলবে না–লাগবে পানি। শুকনো মৌসুমে পানি পেতে হলে বর্ষার পানি ধরে রাখতে হবে নদীতে। তার জন্য চাই বাঁধ। মাথায় করে মাটি ফেলে, কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ গড়েছি, নালা করেছি জমিতে পানি যাওয়ার জন্য। বাঁধ দিয়েছি পুরাতন কুশিয়ারা নদীতে, নালা খুঁড়েছি জমিতে। নদীর মুখে চওড়া উঁচু বাঁধ, অনেক লম্বা আর চওড়া। জমিতে নালা সেও তো কম নয়। যোগ করলে হয়তো আধ মাইল পেরিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ভাবি, এত পরিশ্রমের কাজ আমরা করলাম কেমন করে? কিন্তু করেছি। ফলপ্রসূ হয়েছে আমাদের কাজ। তাই তো আমরা গর্ব অনুভব করি। একি শুধু রুটিনবাঁধা চাকরি? না, সমাজসেবাও? চাষ করেছি পাওয়ার টিলার দিয়ে, ধান রুয়েছি নিজ হাতে আমরাই। সমান দূরত্বে ধানগাছ রোয়ার সে কি নিষ্ঠা! গোছার দূরত্ব ঠিক রাখতে হবে, দড়িতে খোঁচা বেঁধে বর্গাকারে ধান রুয়েছি। চাষীভাইয়েরা দেখত আমাদের কাজ, দেখত আমাদের নিষ্ঠা–বলত, ‘আপনারা শিক্ষিত ছেলেরাও পারেন এ-কাজ এমন সুন্দর করে–যা আমরা পারি না, জানি না।’ মন খুশিতে ভরে উঠত কানায় কানায়।
ইরি ধান লাগিয়েছি নিজেদের আদর্শ খামারে, চাষীভাইদের বুঝিয়েছি ইরি ধানের ফলন আর পরিচর্যা সম্পর্কে, তারাও লাগিয়েছে। পানি আছে, পাম্প নেই। পানির অভাবে পুড়ে ধূসর হয়ে যাবে সবুজ ধানের গাছ। চাষীভাইদের মনে শঙ্কা আর অসন্তোষের আভাস। ছুটলাম পায়ে হেঁটে মার্কুলিতে, ১৮ কিলোমিটার দূরের সেই কন্ট্রোলিং ক্যাম্পে। আমাদের কার্যক্রম সমন্বয়ের ও নিয়ন্ত্রণের ক্যাম্প। বোঝাতে পারলাম কো-অর্ডিনেটরকে, পেলাম সহযোগিতা। নৌকায় পাঠিয়েছিলাম পাওয়ার পাম্প কাগাপাশার আলিমপুরে, গুগরাপুরের আলিমপুরে। অপেক্ষা করছি আমাদের মেকানিক মুসলিমের। ব্যস্ত সে অন্য ক্যাম্পে, পাম্প আর পাওয়ার টিলারের কাজে। এলো মুসলিম। ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে গেছে অনেকটা। তবু যেতে হবে–যেতে হবে আলিমপুরে। বসাতে হবে পাম্প, রক্ষা করতে হবে সবুজ ধানের ক্ষেত। সে কি উন্মাদনা! ভাবলে এখন কষ্ট হয়। মুসলিমকে জিরানোর সময় দিই নি এতটুকু। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে ছুটেছি গুগরাপুর, হেঁটে চলা সেই পথে। ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম, তখন অনেক রাত হয়ে গেছে, নিশুতি রাত। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়েছি। আবার সকালেই মুসলিমকে ছুটতে হবে মার্কুলিতে, আমাকেও যেতে হবে। যেতে হবে আবেদভাইয়ের সেই কনফারেন্সে।
মুসলিমকে যেতে হবে মার্কুলি, মার্কুলি থেকে স্পিডবোট নিয়ে যেতে হবে শেরপুর। শেরপুর থেকে আনতে হবে আবেদভাইকে। মুসলিম বলছে, সকালে আলিমপুর গিয়ে পাম্প লাগাবে। আমি ভাবছি আর মুসলিমকে বোঝাচ্ছি, সকালে পাম্প বসাতে দেরি হলে পাম্পের কাজ শেষ না করেই ওকে চলে যেতে হবে আবেদভাইকে আনতে। বিফল হয়ে যাবে কষ্ট করে আসা। বিফল হয়ে যাবে সব মেহনত। সবুজ ধানগাছ পুড়ে ধূসর হয়ে যাবে।
বুঝল মুসলিম, ছুটলাম দুজন সেই নিশীথে, নিশিপাওয়া মানুষের মতো। আলিমপুর যাচ্ছি রাতদুপুরে। শ্মশানের পাশে নদীর পাড়ে বসাতে হবে আমাদের পাম্প। একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। রূপকথার সেই শ্মশানের ভূতপ্রেতের বাড়িঘরের মতো। হাওর এলাকার হাড়কাঁপানো প্রচণ্ড শীত। খোলা হাওরের কনকনে হাওয়া কাপড় ভেদ করে শরীরে লাগছে, মনে হচ্ছে, যেন বরফের ছোঁয়া। হিমেল বাতাস গায়ে লেগে অবশ করে দিচ্ছে সর্বাঙ্গ। অনুভূতি নেই হাতে-পায়ে। তবু ছুটে চলেছি দু’জনে। হাওরের পথ–সে তো কোনো পথ নয়। কোথাও ডোবা, নালা, খানা-খন্দক আর কাদামাটি। কোথাও শক্ত মাটি আবার কোথাও এক হাঁটু কাদাপানি পেরিয়ে চলেছি আমরা খালি পায়ে। শীতে কাঁপছে সারা শরীর। কিন্তু চলার ক্ষান্তি নেই। গুগরাপুর থেকে আলিমপুর, আমাদের আদর্শ খামার মাত্র দেড় কিলোমিটার। শীত আর ভয় পথকে যেন লম্বা করে দিয়েছে, যেন গন্তব্যে পৌঁছতে দেবে না আমাদেরকে। পৌঁছলাম আলিমপুর, পৌঁছলাম আমাদের আদর্শ খামারে। কাজ শুরু করলাম। পাম্প বসানো হলো। কিন্তু পানি উঠছে না। এবার নামতে হবে পানিতে, টেনে তুলতে হবে চেক ভালব, নন রিটার্ন ভালব। নামলাম দু’জনেই। একা টেনে তোলা যাবে না চেক ভালব। সেই কনকনে ঠাণ্ডা শীতে তারও চাইতে বেশি ঠাণ্ডা বরফের মতো পানিতে নেমে টেনে তুললাম চেক ভালব। পরীক্ষা করে দেখলাম, সব ঠিক আছে কি না। আবার নামলাম, লাগালাম। এমনি বার চারেক প্রচেষ্টার পর সফল হলো আমাদের উদ্দেশ্য।
পাম্প চলছে, পানি উঠছে। কী যে ভালো লাগছে। মন ভরে গেছে খুশিতে। ভুলে গেছি শীতের দংশন, ভুলে গেছি ভয়, চোখের সামনে ভাসছে বড় বড় সোনালি ধানের শীষ ভারে অবনত হয়ে নুয়ে গেছে মাটির দিকে। কাজ শেষ। হাত-পা মুছছি। মুসলিম বলল, ‘স্যার, আপনার পায়ে জোঁক লেগেছে। হারিকেনের আলোয় চেয়ে দেখি, গোড়ালির কাছ থেকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটি জোঁক আমার রক্ত খেয়ে মোটা হয়েছে এক ইঞ্চি। টেনে ছাড়ালাম। রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান থেকে। দেখি, আরও ছোট ছোট জোঁক আমার পায়ের চারদিকে লেগে আছে। ডলে-মলে টেনেটুনে ছাড়ালাম ওগুলোকে আমার পা থেকে। কিন্তু মনে কোনো উদ্বেগ নেই। খুশিতে মন ভরা। ক্যাম্পে যখন পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় ভোর ভোর। হাত-পা ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। গা ঢাকা দিলাম লেপে। চোখ ধরে এসেছে, হঠাৎ মনে হলো, হাঁটুর নিচে কেমন একটা শিহরণ লাগছে। হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম, জোঁকের ক্ষুদে বংশধরদের কেউ কেউ তখনও পা ছাড়েনি। টর্চ জ্বালিয়ে উঠলাম, ওদের ছাড়ালাম পা থেকে। বিছানায় দেখলাম, অনেক রক্ত লেগেছে। কাপড় পুড়িয়ে পায়ে লাগিয়ে বন্ধ করলাম রক্ত ঝরা। ততক্ষণে ভোর হয়েছে। এর মধ্যেই মুসলিম সবাইকে বলে দিয়েছে। শুনে তারা তো হতবাক। সবাই এসে আমাকে প্রশ্ন করছে, এও কি সম্ভব? আমি শুধু বললাম, ‘হয়েছে তো।’
আজ ভাবি তারুণ্যের উদ্দীপনায় তখন যা করেছি, তা কি আমার দ্বারা সম্ভব এখনও? আজও কি ফিরে যেতে পারি সেই স্বর্ণোজ্জ্বল প্রহরে?
সত্যি অসাধারণ অনুপ্রেরনাদায়ী লেখনি।
অসাধারণ! কত নিবেদিত প্রাণের সীমাহীন আত্নত্যাগের ফসল ব্র্যাক
আমি মুগ্ধ !! উনাদের প্রচেষ্টা, ভালোবাসায় আজকের ব্র্যাক! আমাদের স্বপ্ন!!
I read this writing before. it isa part of history of BRAC.
আবেদ ভাই ব্র্যাক শুরু করার সময়ে এরকম কর্মপাগল একঝাঁক তরুণকে পেয়েছিলেন। সেই তরুণরাই তাঁর চিন্তা, দর্শন, কর্মসূচি ও উদ্যোগকে পরম মমতায় এগিয়ে নিয়েছিল। এখানে মোয়াজ্জেম ভাইয়ের যে দু’টি লেখা পুনর্মুদ্রিত হলো সেই লেখা দু’টি অনবদ্য, অসাধারণ! কী সাবলীলভাবেই না ব্র্যাকের এগিয়ে চলার কাহিনি বর্ণনা করলেন! যারা ব্র্যাক সম্পর্কে জানেন না, তারাও লেখা দু’টি পড়লে সবকিছু ছবির মতো দেখতে পাবেন। কী অক্লান্ত পরিশ্রম করে সেদিনের ব্র্যাককে আজকের ব্র্যাকে রূপান্তরিত করলেন! ব্র্যাকের ২৫ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত ‘সেতু’ সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যায় তাঁর লেখা ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ লেখাটি প্রকাশের সঙ্গে আমারও সম্পৃক্ততা ছিল। আবেদ ভাইয়ের প্রথম সামাজিক ব্যসা উদ্যোগ ব্র্যাক প্রিন্টার্সকে বাংলাদেশের একটি শীর্ষ মুদ্রণ… Read more »
We are so grateful to you and your colleagues. You were the real hero of BRAC.
Speechless!!! This is the reality that our founder and many of our predecessors faced especially at the burgeoning stage. Salute Moazzem Hasan Bhai!! Thank you our beloved Abed Bhai.