মায়ের ভাষায় শিক্ষা

February 20, 2024

২০০৩ সালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের জন্য ব্র্যাক আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। এককক্ষ বিশিষ্ট স্কুলগুলোতে চালু হয় মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, যেখানে ব্র্যাকের পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে পড়ানো হতো।

ব্র্যাকের নলেজ ডকুমেন্টেশন কাজের অংশ হিসেবে নানা ধরনের পুরনো নথিপত্র, বই ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহের কাজ চলছে। সেই কাজের সূত্র ধরে বেশ কিছু পুরনো বই আমাদের হাতে আসে। এগুলোর মধ্যে চাকমা ও মারমা ভাষায় লেখা পাঠ্যবইগুলো বিশেষভাবে নজর কাড়ে। বইগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমরা শিক্ষা কর্মসূচির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, এসব বই পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের জন্য পরিচালিত স্কুলে পড়ানো হতো। বর্তমানে সাঁওতাল, ওরাঁও অর্থাৎ সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করছে ব্র্যাকের ‘ব্রিজ স্কুল’।

দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সেবা একসঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করে ব্র্যাকের সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচি (আইডিপি)। এই কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান ভাই জানালেন, আইডিপি-র আওতাভুক্ত বরেন্দ্র এলাকায় সাঁওতাল, ওরাঁও, মাহাতো এবং পাহানদের বাস। এ কারণে সেখানকার ব্রিজ স্কুলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নানা সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। করোনা মহামারির পর থেকে ওই এলাকার ব্রিজ স্কুলে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। একই নিয়মে পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা ও মারমা শিশুদের জন্যও বেশ কয়েকটি স্কুলের কার্যক্রম চলছে।

চাকমা ভাষায় লেখা বই

শিশুদের নিজস্ব সংস্কৃতি লালন ও ভাষাচর্চার বিষয়টি ব্র্যাকের কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারির পর এটি যেন অন্য মাত্রা পেল। করোনার কারণে অনেকদিন স্কুল বন্ধ ছিল। এরপর যখন আবারও ক্লাস শুরু হলো তখন দেখা গেল, প্রত্যন্ত এলাকার অনেক শিশুই স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অনেকেই সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘসময় পড়ালেখা থেকে দূরে থাকার কারণে তারা নতুন করে শুরু করতে ভয় পাচ্ছে। এসব শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্যই ব্র্যাক শুরু করে ব্রিজ স্কুল কার্যক্রম। এই স্কুলে ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়।

বরেন্দ্র অঞ্চল অর্থাৎ দেশের উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার নাচোল, তানোর, পোরশা, পাঁচবিবি এবং তার আশেপাশের ১১টি উপজেলায় বর্তমানে ৪০টি ব্রিজ স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। সাধারণত এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা অন্যদের মতো বাংলা ভাষাতেই পড়ালেখা করে। তবে পাঠ্যবই বাংলায় হলেও এসব স্কুলে শ্রেণিকক্ষে শিখনের সকল নির্দেশনা মাতৃভাষায় দেওয়া হয়। এ ছাড়া সকল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিষয়সমূহ নিয়ে এইসব শিশুদের জন্য কমিউনিটি কারিকুলাম নামে একটি অংশও পড়ানো হয়।

সাঁওতালি ভাষার ছড়া

কোন্ সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী বেশি, তার ওপর ভিত্তি করে কোনোটিতে সাঁওতালি ভাষায় আবার কোনোটিতে ওরাঁও ভাষায় পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। যদি একই স্কুলে দুই ভাষাভাষীর শিক্ষার্থী থাকে, তাহলে একজন শিক্ষিকার পাশাপাশি আরেকজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ধরুন স্কুলে সাঁওতাল ও ওরাঁও দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী আছে। তাহলে শিক্ষিকা যদি সাঁওতালি ভাষায় পাঠদান করেন, তবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সহায়তা করবেন ওরাঁও ভাষায় কথা বলতে পারেন এমন একজন স্বেচ্ছাসেবক। বইয়ের পড়া যখন নিজের ভাষায় বুঝিয়ে বলা হয়, তখন শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ভীতি অনেকটাই দূর হয়। সেইসঙ্গে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি নিজেদের ভাষায় গান, ছড়া, কবিতা, পশু-পাখি-ফলের নাম ইত্যাদি শিখে তারা মাতৃভাষায় আরও দক্ষ হয়ে ওঠে।

মুরারি ও মুন্ডা গান

কথা হলো ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচির প্রোগ্রাম হেড প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মণ দা’র সঙ্গে। তিনি জানালেন, ২০০৩ সালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের জন্য ব্র্যাক আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। এককক্ষ বিশিষ্ট স্কুলগুলোতে চালু হয় মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, যেখানে ব্র্যাকের পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে পড়ানো হতো। স্কুলে একজন বাঙালি শিক্ষক ও একজন চাকমা বা মারমা সম্প্রদায়ের শিক্ষক পাঠদান করতেন। বাঙালি শিক্ষক বাংলা ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো পড়াতেন আর চাকমা বা মারমা সম্প্রদায়ের শিক্ষক তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শেখাতেন। যেহেতু অনেক সম্প্রদায়ের ভাষার কোনো লিখিতরূপ ছিল না, তাই শুধু মৌখিকভাবেই চর্চা করা হতো। ২০০৩ সাল থেকে এভাবেই এগোতে থাকে ৩৬টি সম্প্রদায়ের শিশুদের ব্র্যাক স্কুলের পাঠ।

শিশুদের জন্য রচিত পাঠ্যবই

বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভাষা যেন কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়, সেজন্য ২০০৮ সালের পর চালু করা হয় Multilingual Education (MLE) প্রজেক্ট। এরই অংশ হিসেবে ২০০৮-২০১৩ সালের মধ্যে ব্র্যাক চাকমা সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য ১০টি স্কুল পরিচালনা করে। এরপর ২০১৬ সালে পার্বত্য অঞ্চলের ৫টি স্কুলে মারমা ভাষায় পাঠদান শুরু হয়। ব্র্যাক ২০১৬ সালের পরে জাতীয়ভাবে MLE গ্রুপে কাজ করে এবং সরকারের সঙ্গে ৫টি সম্প্রদায়ের জন্য পাঠ্যবই রচনার কাজে অ্যাডভোকেসি করে।

বাড়িতে শিশুরা মা-বাবা, দাদা-দাদি অর্থাৎ পরিবারের আপনজনদের কাছ থেকে যেসব রূপকথা, লোকগল্প বা গান শুনে বড় হয়েছে তা যদি স্কুলে এসেও শুনতে পায়, তবে কার না ভালো লাগে! ব্রিজ স্কুলে এসে শিক্ষার্থীরা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এমনই এক যোগসূত্র খুঁজে পায়। শিশুদের স্কুলভীতির সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্রিজ স্কুল সেগুলো দূর করার চেষ্টা করে। শিশুরা ব্রিজ স্কুলে তাদের ছোট ভাইবোনদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারে।

হাজং লোককাহিনী

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্র্যাক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকমুখে প্রচলিত গান, কবিতা, ছড়া, গল্পগুলো সংগ্রহ করে তা বই আকারে প্রকাশ করেছে। চাকমা, মারমা ভাষায় লেখা বই যেমন আছে, তেমনি অন্য অনেক সম্প্রদায়ের গল্প, কবিতা, গান নিয়ে বই রয়েছে। সেই বইগুলো নিজস্ব ভাষায় কিন্তু বাংলা লিপিতে রচনা করা হয়েছে।

ব্রাজিলের মানবতাবাদী শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরি বলেছিলেন, ‘প্রকৃত শিক্ষা শিক্ষার্থীর সামর্থ্যের বিকাশ ঘটায়। তাকে স্বাধীন ও সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়ে তার নিজস্ব সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে।’

শিশুদের স্কুলের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে নানা উদ্যোগের মধ্যে একটি হলো শিক্ষার্থীদের মা-বাবা নির্দিষ্ট দিনে স্কুলে এসে যে যা পারেন তাই দিয়ে কিছু না কিছু তৈরি করেন। কেউ পুতুল বানান, কেউবা ঝুড়ি তৈরি করেন। অভিভাবকদের তৈরি করা জিনিসগুলো স্কুল ঘরেই সাজিয়ে রাখা হয়। ব্র্যাক স্কুল সাজানো হয় শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে। এর পাশাপাশি তাদের মা-বাবার তৈরি জিনিসগুলো স্কুল ঘরের শোভা আরও বাড়িয়ে তোলে।

পাহান রূপকথা

বিশেষ এই ব্রিজ স্কুলে আরেকটি বিষয় শিক্ষিকাদের নিশ্চিত করতে হয় যে, তারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। বিষয়টি এজন্য যে, স্কুল শিক্ষিকা কীভাবে ক্লাস নেবেন বা কী পড়াবেন, তার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো যেন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। শিশুদের পড়া বোঝানোর জন্য প্রয়োজনে ভিডিও দেখানোর সুযোগও রয়েছে।

শিক্ষার শুরুটা হোক এমনই সহজ, স্বাভাবিক ও আনন্দময়। মায়ের ভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রতিটি শিশুরই অধিকার। আমাদের সকলের প্রচেষ্টায়ই সম্ভব শিশুদের জন্য মায়ের ভাষায় পড়ালেখার অধিকার নিশ্চিত করা। আর এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টিকে থাকবে মায়ের ভাষা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments