মহাসংকটে মানুষের পাশে

May 7, 2020

লকডাউন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বিভিন্ন যুব সংগঠনকে আমরা সহায়তা সংগ্রহ করা এবং তা শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করতে দেখেছি যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অনেক সহৃদয় মানুষ নিজেরা ছোটো ছোটো গ্রুপ খুলেও এ ধরনের কাজ পরিচালনা করছেন। মূলত শহরকেন্দ্রীকভাবে শুরু হলেও ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক ত্রাণ কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে।

এবার মহামারির কারণে ঘরে বসে আমরা পহেলা বৈশাখ, মে দিবস পালন করেছি। এই উৎসবগুলো সকল শ্রেণি-পেশার মানুষই পালন করে থাকেন। কিন্তু এবার তো ছুটি বা উৎসব কিছুই মনে আনন্দ জাগায়নি। বরং দু’দিনই আমার বারবার মনে হচ্ছিল, কেমন আছি আমরা? কেমন আছে আমার দেশের মানুষ?

উন্নয়ন পেশাজীবী হওয়ায় দেশে-বিদেশে অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্রান্তিক মানুষের কঠিন জীবন সংগ্রামের শত শত গল্প আমার ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। আজ কাকে ফেলে কাকে স্মরণ করব? অল্প বয়সে বিধবা হওয়া উত্তরবঙ্গের সেই হতদরিদ্র নারীর কথা মনে পড়ছে। এক হাত দিয়ে কোলের বাচ্চাকে, অন্য হাত মাথার ওপর শুকনো খড় ভর্তি ঝুড়ি ধরে বহুদূরে  খেতের মালিকের বাড়িতে বয়ে নিয়ে যেতেন।

মনে পড়ছে অন্যের জমিতে কাজ করা সেই নারীশ্রমিকের কথা, যার ছিল মাত্র দুটো শাড়ি। একটি তিনি পরতেন আর অন্যটি দিয়ে তাঁর ভাঙা কুঁড়েঘরটা দেয়ালের মতো ঘিরে রাখতেন যেন ভেতরে শুয়ে থাকা শিশু সন্তানের ওপর কারও নজর না লাগে।

চলমান করোনা সংক্রমণ তো খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। কয়েকদিন আগে ব্র্যাকের এক ভাই রংপুর শহরে বস্তিতে গিয়ে সেখানকার যে অবস্থা দেখেছেন তা বর্ণনা করছিলেন। সেখানে কোল্ড স্টোরেজে কাজ করছেন এমন একজন নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। লকডাউনের কারণে তিনি কাজে যেতে পারছেন না। বাসায় কোনো খাবার নেই। শিশু সন্তানেরা ক্ষুধায় কাঁদছে সারাদিন। ঐ নারী কোল্ড স্টোরেজের মালিকের কাছ থেকে চেয়ে বাতিল করা আলুর স্তূপ থেকে কয়েকটা আলু নিয়ে এসেছেন। আজকের দিনটা এই আলু খেয়েই তারা পার করবেন৷

পরের দিন কী হবে তা তারা জানেন না।

ব্র্যাক পরিচালিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, লকডাউনের কারণে গৃহবন্দি জীবনযাপন করতে গিয়ে দেশে এখন ১৪% পরিবারের ঘরে কোনো খাবার নেই। অতিদারিদ্রের হার বেড়েছে ৬০%। আহারে, খেটে খাওয়া শ্রমিকের জীবন – সে তো পদ্মপাতায় জলের মতো টলোমলো! গার্মেন্টস কর্মীরা একবার মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কষ্ট করে ঢাকায় আসলেন। তারপর ফেরত গেলেন।

সম্প্রতি কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা এলো, কিন্তু ঢাকায় ফেরার জন্য কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা হলো না! এবারও শ্রমিকরা দলে দলে কষ্ট করে ঢাকায় ফিরছেন। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আমাদের মহাসংকট অপেক্ষা করছে। অর্থনীতি গবেষণা সংস্থা সানেম-এর একটি নতুন গবেষণা অনুযায়ী তিন মাস লকডাউন চললে দেশে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হবার আশঙ্কা রয়েছে!

এই মহাসংকট থেকে উত্তরণে আশার প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন কারা?

বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে এককভাবে করোনা সংকট মোকাবিলা করা কঠিন। লকডাউন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই বিভিন্ন যুব সংগঠনকে আমরা সহায়তা সংগ্রহ করা এবং তা শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করতে দেখেছি যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। অনেক সহৃদয় মানুষ নিজেরা  ছোটো  ছোটো গ্রুপ খুলেও এ ধরনের কাজ পরিচালনা করছেন। মূলত শহরকেন্দ্রীকভাবে শুরু হলেও ব্যক্তিগত এবং সাংগঠনিক ত্রাণ কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে।

তার প্রমাণ মেলে আরও একটি গবেষণায়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে দেখা ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এর শিক্ষক শাহাদুজ্জামান স্যারের উপস্থাপিত একটি গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, লকডাউনের এই সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো রকম প্রচারণা ছাড়া অনেক সহৃদয় মানুষ গরিব মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিচ্ছেন। এ রকম ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে সহায়তা পাওয়ার সংখ্যাই নেহাত কম নয়। এরপরেই রয়েছে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কমিউনিটি বেইজড অর্গানাইজেশন বা যুব সংগঠন। তারা স্থানীয়ভাবে সহায়তা সংগ্রহ করা এবং সেগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে।

ব্র্যাক ২০০,০০০ ছিন্নমূল, দিনমজুর ও অতিদরিদ্র পরিবারকে খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে। কিন্তু প্রয়োজন আরও অনেকের। অভাব অনটনে থাকা পরিবারগুলোর সহায়তায় জরুরি খাদ্য তহবিল গঠন করে চেষ্টা চলছে আরও অধিকসংখ্যক মানুষের ক্ষুধা মেটানোর।

ইতিহাস আমাদের মধ্যে আশা জাগায় এই সংকটে। একটু পিছিয়ে গেলে আমরা দেখতে পাই, সকল বিপর্যয়ে দেশকে বাঁচাতে এদেশের সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছে বার বার। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে রানাপ্লাজায় ধ্বংসস্তূপ থেকে বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল সাধারণ মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে গেছেন। ১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম উপকূলের লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেলেন। আরও লক্ষ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন। তখন নিজের চোখে দেখেছি চট্টগ্রাম শহরের অসংখ্য বাড়ি থেকে বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করে দূরদূরান্তে গিয়ে খাবার ও অন্যান্য সহযোগিতা পৌঁছে দিতেন এই সাধারণ মানুষেরাই।

অনেক মানুষ যারা এই কাজে অর্থ দান করছেন, বাসা থেকে খাবার রান্না করে দিচ্ছেন বা খাবার প্যাকেট করছেন, তাদের কথাও বলতেই হয়। শ্রমজীবীদের পাশে তারাও আছেন। সবশেষে, আরও কিছু মানুষের কথা যদি না বলি তাহলে লেখাটা অপূর্ণ রয়ে যাবে। ব্র্যাকসহ অনেক বেসরকারি সংস্থার অসংখ্য কর্মী দেশজুড়ে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার নিয়ম শিখাচ্ছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব বোঝাচ্ছেন। তারা কমিউনিটিতে রিসোর্স মোবিলাইজেশনের কাজ করছেন। স্থানীয় সরকারকে সঠিক মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজে সহায়তা করছেন।

করোনা সংকট মোকাবেলায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলা সকল মানুষেরই পরিবার আছে। স্বজনরা তাদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় থাকেন। তারা নিজেরাও নিশ্চয় সন্তানদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করেন। তবুও দেশের প্রয়োজনে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহরের অলিগলিতে মানুষ কাজ করে চলেছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে সহায়তা নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন। যুব সংগঠনের সদস্যরা খাবারের প্যাকেট হাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে চলেছেন।

শ্রমজীবী, দিনমজুর এবং ছিন্নমূল মানুষের সত্যিকারের বন্ধু তারাই, যারা এই দুর্যোগের মধ্যে সহমর্মিতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারাই আমাদের বাংলাদেশ৷ জাতির দুর্দিনে আশার আলো জ্বালানো এই মানুষগুলোর জন্য রইল শুভকামনা এবং ভালোবাসা।

 

বিপন্ন মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারেন আপনিও: https://www.brac.net/covid19/donate/

 

সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments