নির্যাতন প্রতিরোধে বিনিয়োগ

December 4, 2023

বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক অপরাধ। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং নির্যাতিত এমন নারীদের জীবনে সাধারণত যা ঘটে থাকে তা হলো, পারিবারিক নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে একজন নারী যখন মুক্তি চান তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

সেদিন গিয়েছিলাম যশোরের অভয়নগরে। ব্র্যাক অফিসে বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) এবং অভিযোগ গ্রহণের তারিখ ছিল। তিনজন এসেছেন বিরোধ মীমাংসার জন্য, চারজন এসেছেন অভিযোগ জানাতে। সাতজনের মধ্যে একজন নারীর বয়স প্রায় পঞ্চান্ন, বাকিদের বয়স বিশ-বাইশ এর মধ্যে হবে। তাদেরই একজন লিমা (ছদ্মনাম)। আনুমানিক সতেরো বছরের কিশোরী লিমাকে নিয়ে তার মা জড়োসড়ো হয়ে এক কোনায় বসে আছেন। লিমার কোলে এক বছর বয়সী সন্তান।

লিমার কাছে জানতে চাইলাম, এখানে কেন এসেছেন?

আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন লিমার মা। তিনি বললেন, “দুই লাখ সত্তর হাজার টাকা দিছি হুন্ডা কিনার জন্য। সেই টাকাটা উঠাইয়া দেন।” বলতে বলতে তিনি কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলেন।”

“হুন্ডা কি বিয়ের সময় দিয়েছেন?”

“না, পরে। জামাইয়ের মান রাখতে।”

“এত অল্পবয়সে মেয়েকে লেখাপড়া না করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন!”

“ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরি করে। ভালো ছেলে। হাতছাড়া করতে চাই নাই।“

লিমা ক্লাস নাইনে পড়ছিল। ভালো পাত্রের বাসা থেকে প্রস্তাব আসায় তারা রাজি হয়ে যান। কিন্তু লিমার স্বামী এখন আর সংসার করতে চাইছে না। তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে। মা যখন অভিযোগ দাখিল করছিলেন, লিমা তখন মাথা নিচু করে কোলের সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে।

এ শুধু লিমা নয়, অনেকের জীবনেই সত্য। জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ভয়াবহ এক রূপ হলো বাল্যবিয়ে। ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস (এমআইএস) ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, যশোরে দেনমোহর ও ভরণপোষণ বিষয়ক মীমাংসা হওয়া ৩০০টি অভিযোগের অর্ধেকের বেশি (৫৫%) নারী বাল্যবিয়ের শিকার।

বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক অপরাধ। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছে এবং নির্যাতিত এমন নারীদের জীবনে সাধারণত যা ঘটে থাকে তা হলো, পারিবারিক নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে একজন নারী যখন মুক্তি চান তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। জীবনকে নিজের মতো সাজিয়ে নেওয়ার নানা সুযোগ ইতিমধ্যে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। সে না শিখেছে লেখাপড়া, না শিখেছে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার কৌশল, আবার কোনো কাজের সঙ্গেও যুক্ত নেই। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল থাকলে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই করার মনের জোর থাকে। কিন্তু যে নারী জানে যে, তার খাওয়া-পরা, বাসস্থানের ব্যবস্থা সে নিজে করতে পারবে না, তাকে অনেক কিছুই ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নিতে হয়।

সমীক্ষামতে, পনেরো থেকে উনিশ বছর বয়সী নারীর প্রতি চারজনের মধ্যে একজন  কখনও না কখনও গর্ভবতী হয়েছেন। তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন জীবিত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ১৬৮ জন মায়ের সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে। এই হার পৃথিবীর উচ্চ মাতৃমৃত্যুর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। (সূত্র: এসআরভিএস ২০২১, বিডিএইচএস ২০২২)

পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয় যে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীর শিক্ষা খাতে এবং তাদেরকে স্বাবলম্বী করে তোলার চাইতে বিয়েতে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী। এ কারণে যৌতুক প্রথা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এডুকো)-এর জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা এবং তার প্রভাব শীর্ষক গবেষণায় অংশ নেওয়া শতকরা ৫৪ দশমিক ৯ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন বাল্যবিয়ে হচ্ছে সবচেয়ে ভয়াবহ জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা।

ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি বাংলাদেশের ৩১টি জেলার ২৪০ উপজেলায় পারিবারিক নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া নারী ও কন্যাশিশুদের আইনি সহায়তা প্রদান করছে, সেইসঙ্গে বাল্যবিয়ে মূলোৎপাটনে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা প্রায় ষাট (৬০) হাজার কিশোরীকে নিয়ে স্বপ্নসারথি নামে দল গঠন করে জীবন দক্ষতার ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে মা-বাবাসহ অভিভাবক, স্থানীয় জনগণকে নিয়ে ওয়াচ দল, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, কাজি, ইমাম, পুরোহিত, ‍উপজেলা বাল্যবিয়ে নিরোধ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সচেতনতামূলক সভা, জাতীয় পর্যায়ে অ্যাডভোকেসিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি স্বপ্নসারথিদেরকে বিভিন্ন সেশনের মাধ্যমে জীবন দক্ষতার ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়

সহিংসতার প্রশ্নে, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষর, শহুরে-গ্রামীণ, স্বাবলম্বী-প্রান্তিক সকল নারী  এক বিন্দুতে মিলে যায়। মেয়েদের শিক্ষা, জেন্ডার সচেতনতা এবং জীবনমুখী দক্ষতার উন্নয়নের খাতে যথাসাধ্য বিনিয়োগ করুন। তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য করে তুলুন।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments