আয়েশা আবেদের জীবন ছিল প্রকৃতই কর্মময়। আর তাঁর কর্মভাবনার মূলে ছিল এদেশের দরিদ্র মানুষ। একাধারে তিনি ছিলেন কর্মী, সংগঠক এবং পরিকল্পক, অন্যদিকে নিজের পরিবারপরিজন এবং বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহ এবং ভালোবাসার আশ্রয়।
ব্র্যাকের সূচনার দিনগুলোতে সমস্ত কর্মপ্রয়াসের সঙ্গে একটি উজ্জ্বল নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ছিল। সেই নাম আয়েশা হাসান আবেদ। অকালপ্রয়াত এই মহীয়সী নারীর নাম ব্র্যাকের অস্তিত্ব ও কর্মধারার সঙ্গে আজও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ব্র্যাককর্মী এবং কর্ম-এলাকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘ভাবী’ আর পরিবারপরিজন ও বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন ‘বাহার’। যে নামেই ডাকা হোক, অকালমৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ব্র্যাকের আত্মা। গভীর মমতা এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের আভায় তিনি ব্র্যাকপরিবারের সকলকে নিবিড় বন্ধনে বেঁধেছিলেন। ব্র্যাকের উত্থানকালের সেই গতিশীল দিনগুলোতে ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে তিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর পাশে। অসহায় দরিদ্র মানুষকে সংগঠিত করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে ব্র্যাকের যে অঙ্গীকার, তারই সঙ্গে নিজেকে তিনি একাত্ম করে নিয়েছিলেন।
আয়েশা আবেদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৩ই জানুয়ারি ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ শহরে। তাঁর পিতা ইয়াহিয়া খান চৌধুরী ছিলেন তদানীন্তন ব্রিটিশ-ভারতের করিমগঞ্জ মহকুমার প্রশাসক। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে আয়েশা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। পিতার চাকরিসূত্রে ছোটোবেলা থেকে দেশের বিভিন্ন শহরে তিনি বেড়ে উঠেছেন। ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে সিনিয়র কেম্ব্রিজ পাশ করার পর তিনি কুষ্টিয়া কলেজে অধ্যয়ন করেন। এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকার হলিক্রস কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় হলিক্রস কলেজ থেকে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ব্র্যাক তখন সবেমাত্র তার যাত্রা শুরু করেছে। সুনামগঞ্জের শাল্লায় শুরু হয়েছে ব্র্যাকের সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রা।
১৯৭৩ সালের ৭ই এপ্রিল ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের কিছুদিন পরেই আয়েশা আবেদ শাল্লায় গিয়েছিলেন। সেখানে তখন পুরোদমে চলছে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ। যুদ্ধফেরত সহায়সম্বলহীন মানুষ জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে। তাদের সুখ-দুঃখ এবং জীবনসংগ্রামের অংশ হয়ে ব্র্যাককর্মীরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বন্ধুর মতো। সেখানেই ব্র্যাকের এই বিপুল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হলো আয়েশা আবেদের। মানুষের জীবনসংগ্রাম তাঁকে আলোড়িত করেছিল। গ্রামবাংলার মানুষের সঙ্গে কাজ করবার এক গভীর তাড়না অনুভব করেন তিনি।
এরপর তিনি নির্বাহী সহকারী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাকে যোগ দেন। সেই সময়ে শ্রীলঙ্কার এক নৃতত্ত্ববিদ সেনারত্ন ব্র্যাকের গ্রাম সমীক্ষা প্রকল্পে কাজ করার জন্য এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন গ্রামে ব্র্যাকের গবেষকদলের সমন্বয়কারী হিসেবে আয়েশা আবেদ গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা এবং উন্নয়নের নানা দিক সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ক্রমশই তাঁর ভাবনা এবং কর্মের দিগন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি এই সত্য উপলব্ধি করেন, সমাজের বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত হয়ে নিজেদের অধিকার নিজেদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক্ষমতাবানদের একচ্ছত্র প্রভাব ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে সজাগ ও সচেতন করে তুলতে হবে। গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের জন্য গ্রহণ করতে হবে বাস্তবমুখী কর্মসূচি। আর তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন দরিদ্র মানুষের শক্তিশালী সংগঠন। মানুষকে সচেতন করে তাদের সংগঠিত করা এবং সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন ও উপার্জনমুখী কাজে আগ্রহী করে তোলার জন্য তিনি কাজ শুরু করেন। গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা অর্জনের জন্য তিনি গবেষণাকাজে যুক্ত হলেন।
আয়েশা আবেদের বিশ্বাস ছিল সাক্ষরতা ও সচেতনতা দুটোকেই একসঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। বয়স্কদের জন্য ব্যবহারিক শিক্ষার উপকরণ তৈরি করার প্রয়োজনে ১৯৭৪ সালে ব্র্যাক ম্যাটেরিয়াল ডেভেলপমেন্ট ইউনিট গড়ে তোলে। এই ইউনিট গড়ে তোলা এবং পরিচালনায় আয়েশা আবেদ অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ব্রাজিলের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির দর্শন ও পদ্ধতির আলোকে বয়স্ক সচেতনতা এবং সাক্ষরতাবিষয়ক উপকরণ, স্বাস্থ্যশিক্ষা চিত্রমালা প্রভৃতি তৈরির ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন প্রধান দিকনির্দেশক। ব্র্যাকের ব্যবহারিক শিক্ষা কর্মসূচিতে এই উপকরণগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
বস্তুত, উন্নয়নকর্মকাণ্ডের শুধু প্রায়োগিক দিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক দিক নিয়ে সমান আগ্রহ ছিল তাঁর। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮১ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের মাসিক পত্রিকা ‘গণকেন্দ্র’-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই পত্রিকার বিকাশ ও গণমুখী চরিত্রের জন্য তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস। একটি ন্যায়ভিত্তিক, বঞ্চনামুক্ত এবং সমৃদ্ধিশালী সমাজগঠনে তাঁর সুদৃঢ় অঙ্গীকার এই পত্রিকায় প্রতিফলিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীসমাজ, পরিবারকাঠামোতে তাদের অবস্থান এবং তাদের ক্ষমতায়ন বিষয়ে আয়েশা আবেদ গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি ছিলেন দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ মানুষের মুক্তি অন্বেষায় একজন সক্রিয় কর্মী। সামগ্রিক উন্নয়নকর্মকাণ্ডে নারীদের যুক্ত করে কীভাবে তাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা যায়, সেই ভাবনা তাঁকে আজীবন অধিকার করে ছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের শাল্লা, মানিকগঞ্জ ও জামালপুর প্রকল্পের কর্মসূচিসমূহে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষত গ্রামীণ নারীদের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটে। জামালপুরের প্রকল্পটি ছিল সম্পূর্ণরূপে নারীকেন্দ্রিক। নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তিনি এ অঞ্চলের নারীদেরকে আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করেন। একইসঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ করেন নারীকর্মীদের পণ্যসামগ্রী বিপণনের কোনো ক্ষেত্র নেই, অথচ এসব সামগ্রী বাজারজাত করে সহজেই তাদেরকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার পথে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। ভাবনার এই প্রেক্ষাপট থেকেই তিনি ‘আড়ং’ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯৮০ সালে এমসিসি-র কাছ থেকে আড়ং-এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ব্র্যাকের কাছে হস্তান্তরিত হয়। সে সময় থেকে জীবনের শেষ দু’টি বছর আয়েশা আবেদ আড়ং-এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আড়ং-এর ক্রমবিকাশ এবং প্রসারের এই সন্ধিক্ষণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আরও বেশি কর্মমুখর ও প্রাণচঞ্চল। এ সময়ই ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজিত ব্র্যাকের সাড়াজাগানো জামদানি প্রদর্শনী সফল করে তোলার জন্য তিনি অসম্ভব পরিশ্রম করেছিলেন।
আয়েশা আবেদের জীবন ছিল প্রকৃতই কর্মময়। তাঁর কর্মভাবনার মূলে ছিল এদেশের দরিদ্র মানুষ। একাধারে তিনি ছিলেন কর্মী, সংগঠক এবং পরিকল্পক, অন্যদিকে নিজের পরিবারপরিজন এবং বন্ধুদের কাছে তিনি ছিলেন স্নেহ এবং ভালোবাসার আশ্রয়। দক্ষতা, সততা এবং একনিষ্ঠতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মিষ্টভাষী, সদালাপী এই মানুষটির অন্তরে ছিল দেশের বঞ্চিত জনসমাজ বিশেষত নারীদের জন্য গভীর মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা। এই ভালোবাসা শুধু অনুভবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথ করে দিয়ে, পরিবার ও সমাজজীবনে তাদের স্বীকৃতি ও সম্মান এনে দেওয়ার প্রচেষ্টায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মধারায় তাঁর অংশগ্রহণ ছিল প্রত্যক্ষ এবং সার্বক্ষণিক। সংস্থার নীতিনির্ধারণ, কর্মসূচি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই ফজলে হাসান আবেদের পাশে থেকে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। ছোটবড় যে কোনো কাজেই তাঁর ছিল তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও দায়িত্ববোধ। সেইসঙ্গে ছিল গভীর মানবিক অনুভব এবং সংবেদন। ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে তিনি বহু কর্ম-এলাকায় ঘুরেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে দরিদ্র মানুষের কুঁড়েঘরে তিনি উপস্থিত হয়েছেন পরম আপনজনের মতো। তাঁর আসার খবর পেয়ে দলেদলে ছুটে আসত গ্রামীণ নারীরা। সবাই চাইত তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। মার্কুলি অফিসের সেই সময়কার বোটম্যান আবুল কাশেম স্মরণ করতে পারেন, সারাদিনের কর্মব্যস্ততার শেষে অফিসে ফিরে এসে আয়েশা আবেদ হারিকেনের আলোয় তাকে বর্ণপরিচয় শেখানোর জন্য পড়াতে বসেছেন।
১৯৮১ সালের ১১ই জুলাই যখন তাঁর মৃত্যু হলো, তখন সমগ্র ব্র্যাকপরিবারে সেই মৃত্যুর বেদনা অত্যন্ত গভীরভাবে বেজেছিল। দুই সন্তান তামারা ও শামেরানকে রেখে তাঁর এই চিরপ্রস্থানের ক্ষতি আর কখনই পূরণ হয়নি। স্বল্পকালীন জীবনে মেধা, সৃজনশীলতা ও অঙ্গীকার দিয়ে তিনি যে উচ্চ প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিলেন, মৃত্যু এসে তা অকস্মাৎ স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
আয়েশা আবেদ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জীবিকার সংস্থান এবং ক্ষমতায়ন নিয়ে আজীবন কাজ করে গেছেন। সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে তাঁর মৃত্যুর পর গড়ে তোলা হয় আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের উপার্জনক্ষম ও স্বাবলম্বী করে তোলার কর্মকাণ্ড হাতে নেওয়া হয়। এর আগে আড়ংয়ের মাধ্যমে কারুপণ্য উৎপাদনের কাজ চলছিল। এবার আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন সেই কর্মকাণ্ডের আরও বিস্তার ঘটানোর উদ্যোগ নেয়। গ্রামাঞ্চলের যেসব নারী হাতের কাজে দক্ষ ছিলেন, তাঁরা সরাসরি কাজের সুযোগ পেলেন। আগ্রহীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদেরকে হাতেকলমে কাজ শেখানো হলো।
১৯৮৩ সালে ফাউন্ডেশনের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় মানিকগঞ্জে। এর পর একে একে জামালপুর, শেরপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, বানিয়াচং, গড়পাড়া, পাবনা, রাজবাড়ি, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ত্রিশাল ও কক্সবাজার উখিয়াতে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা হয়। এই ১৫টি ফাউন্ডেশনের অধীনে ১১টি সহায়ক উৎপাদনকেন্দ্র এবং ৮০২টি উপকেন্দ্রে প্রায় ৭০ হাজার নারী কাজের সুযোগ পেয়েছেন। বস্তুত এদের জন্যই আয়েশা আবেদ তাঁর জীবনের যাবতীয় কর্মপ্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করেছিলেন। এই কর্মজীবী নারীদের অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতাই তাঁর স্বপ্নকে অনেক অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে।
আয়েশা আবেদ আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্মৃতি ব্র্যাকে সর্বদাই বহমান এবং তাঁর আকস্মিক ছেদ অনাগত দিনগুলোতে একটি অনিঃশেষ আক্ষেপ হয়ে থাকবে।
আয়েশা আবেদ ম্যামের জীবনী অডিও ফর্মে কি পাওয়া যাবে?