মো. মোয়াজ্জেম হাসান ১৯৭২ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি ব্র্যাকের মাঠ পর্যায়ের প্রথম কর্মী হিসেবে সুনামগঞ্জের শাল্লার দিরাই ক্যাম্পে যোগদান করেছিলেন। যোগদানের কিছুদিন পরেই তাঁকে হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে মার্কুলী ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ব্র্যাকের শুরুর দিকের পুনর্বাসন কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
১৯৭৭ সালে ব্র্যাকের প্রথম সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ ‘ব্র্যাক প্রিন্টার্স’-এর কার্যক্রম শুরু হলে তাঁকে সেখানে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এরপর প্রায় ৩০ বছর তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালে ব্র্যাক থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনি ‘ব্র্যাক প্রিন্টার্স’-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৭ই মে ২০২১ তারিখ সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকাস্থ একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না …
প্রত্যন্ত গ্রামের দুজন নারী কেমন করে করোনাকাল পার করলেন সেই গল্পটি জানাতে চাই।
প্রথমজন রংপুর জেলার আমরুলবাড়ি গ্রামের সিন্ধুবালা।
কোভিড-১৯ এর শুরু থেকে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থবিধির সব নিয়ম মেনে চলেছেন। পাশাপাশি আশেপাশের সকলে যেন মাস্ক ব্যবহার করেন, কিছুক্ষণ পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোন এবং ভিড় এড়িয়ে চলেন সেজন্যও সচেতনতামূলক কাজ করেছেন। এমনকি যারা খাবারের অভাবে ছিল তিনি তাদেরও সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন।
মহামারি শুরুর পর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে তিনি বুঝতে পারেন আগামী দিনগুলো হয়তো কঠিন হবে। তিনি ধারণা করতে পারছিলেন আয়রোজগারে টান পরতে পারে। এ কারণে শুরুর দিকেই পাইকারদের কাছে নিজের নার্সারির অনেক চারা গাছ বিক্রি …
“আমি জীবনে অনেক পরাজিত পুরুষ দেখেছি, কিন্তু কোনো পরাজিত নারী দেখিনি”
– স্যার ফজলে হাসান আবেদ
ত্রিশ বছর আগে কলেজে পড়ার সময় কাছমিনের বিয়ে হয়। স্বামী পুলিশের কর্মকর্তা। বিয়ের পর পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও স্বামী আর তিন বছরের মেয়ে নিয়ে সুখেই ছিলেন কাছমিন।
বিবাহিত জীবন ছয় বছরে গড়ানোর আগেই তিনি বুঝলেন স্বামীর পরকীয়া করছে । প্রেমিকা কাছমিনের আপন চাচাতো বোন। প্রতিবাদ করেন স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু বিনিময়ে মেলে প্রচণ্ড শারীরিক, মানসিক নির্যাতন। তিন বছরের মেয়েসহ এক কাপড়ে ঢাকার বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। এরপর তিনি আশ্রয় নেন জামালপুরে শ্বশুর বাড়িতে। স্বামীর মারধোর, অপমান সব সহ্য করার পরও আশায় ছিলেন …
“বাবার বাড়ি এই গাঁয়ে,
শ্বশুরবাড়ি ঐ।
তোমার বাড়ি কই গো নারী?
তোমার বাড়ি কই?”
আপনমনেই অনেকদিন আগে শোনা একটা কবিতার কিছু লাইন মনে পড়ল সুফিয়ার কথা শুনে। ২০০৫ সালের আলট্রা-পুওর কর্মসূচির একজন গ্র্যাজুয়েট তিনি। প্রথম জীবনে স্বামী ও ৩ কন্যা সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার থাকলেও, অল্প বয়সেই তিনি স্বামীকে হারান।
এরপর থেকেই বদলে যায় তার জীবন।
জীবনের কষ্টের কথা বলছিলেন সুফিয়া, “মেয়ে মানুষের কী সত্যিই আলাদা কোনো ঘর আছে? পরিচয় আছে? যতদিন স্বামীর ঘর করতাম, ততদিন থাকতাম শ্বশুরের ভিটায়, যখন ঐ বাড়ি থেকে বের করে দিল, এসে উঠলাম বাপের ভিটায়, সেই ভিটাও ভাই তার নিজের নামে লিখে নিল, আমার …
রুমা বেগমকে দেখে আব্দুল শহীদ বললেন, ‘কিতা রেডিও আফা, বালানি?’ রুমা বেগম আমার দিকে তাকালেন। আমিও হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। রুমা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে মৌলভীবাজারের উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে হাঁটছিলাম। পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমেই এক বাড়ির বারান্দায় দেখা হলো আব্দুল শহীদের সঙ্গে। মিষ্টি রোদে বসে রেডিওতে গান শুনছেন।
তার রেডিও থেকে ভেসে আসছে গান- ‘করোনাভাইরাস থাকি বাছার লাগি দরকার ছাড়া বারে গোরাগোরি করবা না। মাস্ক পিনদইন। চউক, নাখ, মুকঅ হাত লাগানি বাদ দেইন। সাবান দিয়া একটু বাদে বাদে ২০ সেকেন্ড কইরা হাত দউকা। পয়লা হাতর তালুর মাঝে সাবান আর নাইলে হ্যান্ড ওয়াশ নিয়া…’
আজকাল রুমা বেগমকে অনেকেই ‘রেডিও আপা’ বলে …
২০১৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর। মৃদু শীতের বিকেল। মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার অডিটরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। উপলক্ষ্য একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। এ রকম অনুষ্ঠান তো কতই হয়। এই অডিটরিয়ামেই অনেক হয়েছে। কিন্তু আজ যেন একটু আলাদা, একটু অন্যরকম। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ হাসপাতালে। জীবনের শেষ কয়েকটি দিন তাঁর সেখানেই কাটছে। বিকেলের অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে সকালের দিকে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে গেলাম। অসুস্থতার সময় বেশ কয়েকবার গিয়েছি তাঁকে দেখতে। স্ত্রী নীলোফার আমার সঙ্গী। রুমে ঢুকে দেখতে পেলাম সারওয়াত ভাবীকে। স্যুইটের অপর পাশে আবেদ ভাই শুয়ে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ভাবী বললেন, ভাই ঘুমোচ্ছেন। কিছুক্ষণ বসার পর ভেতর থেকে কেউ …
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাড়তি বৈশ্বিক মনোযোগ এবং বিনিয়োগ দুটোই কিছুটা হলেও হয়েছিল।
সার্বিক উন্নয়ন তথা শিক্ষা, অর্থনীতি বা নারীর ক্ষমতায়ন স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব ফেলে তার অনেক তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উদাহরণও বিশ্বব্যাংকের উল্লিখিত প্রতিবেদনে ছিল। ব্র্যাকের কাজেও আমরা এর প্রতিফলন দেখেছি। যার বেশকিছু নিদর্শন ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু উল্টোটা অর্থাৎ স্বাস্থ্যের ওপর সার্বিক উন্নয়নের প্রভাব আমরা খুব বেশি দেখাতে পারিনি। এমনকি বৈশ্বিকভাবেও এর নিদর্শন খুব একটা চোখে পড়ে না।
১৯৯২ সাল থেকে পরবর্তী প্রায় এক দশক চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলায় ব্র্যাক ও আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে এক নিবিড় গবেষণা চালায়। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফল বিশ্লেষণ …
বেলিয়ারা বেগম দিনাজপুরের খাজিন্দাপাড়ার জগদল গ্রামে থাকেন। তার ৩ ভাই ও ৩ বোন। বড়ো ভাই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের নির্ভীক সৈনিক। একসময় তারা ভালোই ছিলেন, কিন্তু সবসময় ভালো থাকা গেল না।
বেলিয়ারা তখন সবে কৈশোরে পা রেখেছেন। মায়ের হলো ভীষণ অসুখ। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কয়েক মাস রোগে ভুগে মা মারা গেলেন। সংসারে নেমে এলো আঁধার। বাবা আবার বিয়ে করলেন। নতুন মা এসেই বোনদের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। একে একে দুই বোনের বিয়ের হলো, কারও বয়সই ১৮ বছর পেরোয়নি।
দুই বোনের পর এবার বেলিয়ারার পালা। তখন তার মাত্র ১৪ বছর বয়স। সৎমা এবং বাবাকে জানিয়েছিলেন তিনি এখনই বিয়ে করতে চান না। কিন্তু …
আমি কখনও করুণা চাই না, কারও করুণা নিতেও আমার ভালো লাগে না। যে কারণে আমার সম্প্রদায়ের অন্যদের সাথে আমি ‘কালেকশনে’ খুব একটা যেতে চাইতাম না। আমি আমার নিজের এবং আমার সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের একটি সম্মানজনক জীবনের স্বপ্ন দেখি।
“বাবা-মায়ের সাথে গত ১২ বছর ধরে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যেটুকু এগোতে পেরেছি, পুরোপুরি আমার নিজের চেষ্টায়।”
ছোটোবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গে খেলতে ভালো লাগত। ছেলেরা এই বিষয় নিয়ে অনেক বিরক্ত করত, বাজে মন্তব্য করত। কিন্তু শিক্ষকরা আমাকে খুব আদর করতেন।
আমার ইচ্ছা করত শাড়ি পরতে, তাই সুযোগ পেলে চাচিদের কাছে আবদার করতাম, তাদের শাড়ি পরতাম। বাবা-মা এটা সহ্যই করতে পারতেন না, অনেক মারধর …
জনবহুল এই দেশে কারও অধিকার কেড়ে নিয়ে তার জীবনকে মূল্যহীন হিসেবে আখ্যা দেওয়া অনেক সহজ।
জাতিগতভাবে যে চর্চা আমরা বহুবছর ধরে করে আসছি, তা হলো নারীর প্রতি বৈষম্য। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কাছে একজন নারীর স্বপ্ন, আশা বা লক্ষ্য খুবই ঠুনকো। নারীদের কোনঠাসা করে রাখার সেই প্রতিযোগিতায় পুরুষ দোর্দন্ড প্রতাপশালী, যেন তার ওপর আর কেউ নেই।
যার গল্পের সূচনায় কথাগুলো বলা, তার নাম কনিকা রানী পাল। গ্রামের কারও কাছে তিনি কনিকা মাসি, কারও কাছে দিদি। জীবনের মধ্যগগনে পৌঁছেছেন তিনি, কিন্তু লড়াই তার থামেনি। তিন সন্তানের মধ্যে ছেলে দুইজন কাজ শিখছে, মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে- আপাতদৃষ্টিতে ঝামেলামুক্ত সংসার। কিন্তু আসলেই কি তাই?
মৌলভীবাজারের …
করোনাভাইরাস মহামারির টানা ৬-৭ মাস যাবৎ স্কুল বন্ধ। টেলিভিশনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে, স্কুলগুলো ক্লাস নিচ্ছে অনলাইনে। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু, যে লেখাপড়া করে ব্রেইল পদ্ধতিতে, সে কীভাবে ক্লাস করবে অনলাইনে? সবাই যেখানে মাস্ক পরে চলাফেরা করছে, একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ যে ইশারা ভাষার ওপর নির্ভরশীল, তিনি আরেকজনের মুখমণ্ডল পুরোটা দেখতে না পেলে ইশারা ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন কি?
কোভিডের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা এখনও যে কথাটি বলছেন না, তা হলো, কোভিডের কারণে বিভিন্ন অঙ্গে যে রক্ত শরীরে জমাট বেঁধে যাচ্ছে, সারা দেহের ত্বকের নিচে যে অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র রক্তনালি রয়েছে, সেগুলোতেও একইভাবে জমাট বাঁধছে রক্ত। এর ফলে ত্বকের নিচে স্পর্শের মাধ্যমে …
আগের সপ্তাহে নাড়ু বানিয়েছিলেন মঞ্জু দিদি। মাটির রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা পাকা রাস্তা, তার উপর দিয়েই নেতৃসুলভ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে নিজের বাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে তিনি বলছিলেন- নাড়ু গতকাল পর্যন্ত ছিল। আমরা আজ আসব আগে জানলে তিনি রেখে দিতেন। এর পরের বার আসলে যেন আগে থেকে তাকে জানিয়ে আসি। অফিসের ভাইরা এসেছি তার বাড়িতে, অথচ নাড়ু খাওয়াতে পারলেন না, এই নিয়ে আফসোস করলেন পরিচয়ের প্রথম ৫ মিনিট।
মঞ্জু রানী দাশের সঙ্গে ব্র্যাকের প্রথম পরিচয় হয় তার জীবনের আর্থিক সংকটের এক সময়ে, কিস্তি ঋণের গ্রাহক হিসেবে। সেই পরিচয়টা কেন দেরিতে হয়েছিল তা নিয়ে হয়তো তার আফসোস থাকতে পারে, কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে …