অতিদারিদ্র্যের বৃত্ত ভেঙ্গে নেতৃত্বে নারী

March 7, 2021

এবছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে- “নেতৃত্বে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি” অর্থাৎ পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যেন সমানভাবে নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আশার কথা এই যে, বর্তমানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, বিভিন্ন সংস্থা নারীর প্রতি ঘটে চলা নির্যাতন, হয়রানি এবং বঞ্চনার বিপক্ষে কথা বলছে, কাজ করে চলেছে মানবাধিকার ও লিঙ্গসমতা অর্জনের জন্য।

“বাবার বাড়ি এই গাঁয়ে,
শ্বশুরবাড়ি ঐ।
তোমার বাড়ি কই গো নারী?
তোমার বাড়ি কই?”

আপনমনেই অনেকদিন আগে শোনা একটা কবিতার কিছু লাইন মনে পড়ল সুফিয়ার কথা শুনে। ২০০৫ সালের আলট্রা-পুওর কর্মসূচির একজন গ্র্যাজুয়েট তিনি। প্রথম জীবনে স্বামী ও ৩ কন্যা সন্তান নিয়ে তার সুখের সংসার থাকলেও, অল্প বয়সেই তিনি স্বামীকে হারান।

এরপর থেকেই বদলে যায় তার জীবন।

জীবনের কষ্টের কথা বলছিলেন সুফিয়া, “মেয়ে মানুষের কী সত্যিই আলাদা কোনো ঘর আছে? পরিচয় আছে? যতদিন স্বামীর ঘর করতাম, ততদিন থাকতাম শ্বশুরের ভিটায়, যখন ঐ বাড়ি থেকে বের করে দিল, এসে উঠলাম বাপের ভিটায়, সেই ভিটাও ভাই তার নিজের নামে লিখে নিল, আমার জন্য রইল না কিছুই!”

ব্র্যাকে আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচিতে যোগদানের প্রায় ছয় বছর পূর্ণ হতে চলেছে। কাজ করার সুবাদেই ঘুরে ফেলেছি দেশের দারিদ্র্যপীড়িত বেশিরভাগ জেলা। আমার কাজ যেহেতু অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী নিয়েই, তাই অতিদরিদ্র জনগণ, বিশেষ করে অতিদরিদ্র নারীদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

কাজ করতে গিয়ে জেনেছি, অতিদারিদ্র্যের বহুমুখী রূপ, যার সম্পর্কে আগে ধারণাই ছিল না। শুনেছি ভুক্তভোগীদের চরম দুর্ভোগের কথা!

২০০২ সালে শুরু হয় আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ। এটি ব্র্যাক উদ্ভাবিত দারিদ্র্য বিমোচনের একটি কার্যকর মডেল, যার মাধ্যমে অতিদরিদ্র এবং আলট্রা-পুওর জনগোষ্ঠীকে সর্বাঙ্গীন সহায়তা প্রদান করা হয়। ফলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অতিদরিদ্র বা আলট্রা-পুওর পরিবারের সদস্যদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পেয়ে সম্পদ সম্প্রসারণসহ তাদের মানসিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং সদস্যরা মূলস্রোতধারার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে।

এখন পর্যন্ত এই কর্মসূচিটি ২১ লক্ষেরও অধিক অতিদরিদ্র তথা আলট্রা-পুওর নারী এবং তাদের পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করেছে। বিষয়টি এমন নয় যে, এই পরিবারগুলোর কেবলমাত্র আর্থিক বা সামাজিক পরিবর্তন আসছে, বরং তাদের মাঝে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে সক্ষমতা তৈরি হয় সেটা সত্যিকার অর্থেই আমাকে অভিভূত করে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্রমতে, এই দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের শতকরা ৯০ ভাগ কর্মীই নারী। করোনাকালে ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ বিভাগের করা একটি গবেষণাতে দেখা গেছে, এই খাতে কর্মরত নারীরাই পুরুষের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাকরি হারানো কিংবা সাধারণ ছুটির সময় কাজে যেতে না পারাদের মধ্যেও নারীর সংখ্যাই বেশি।

তবে আশার ব্যাপার হলো, এই কঠিন সময়েও ২০২০ কোহর্টের ইউপিজি সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ সদস্য অতিদারিদ্র্য থেকে সফলভাবে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে ইউপিজি প্রোগ্রামের অতিদরিদ্র সদস্যদের এগিয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা এবং কর্মীদের সকল বাধা অতিক্রম করে করোনাকালে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়ার কারণে।

এই লেখার শুরুতে সুফিয়ার কথা বলছিলাম। ২০০৫ সালে আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের পর কেবলমাত্র তার অর্থনৈতিক অবস্থার এতোটাই পরিবর্তন ঘটেছে যে, তিনি এখন নিজের জন্য দুই কক্ষবিশিষ্ট পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন।

তার তিন কন্যা সন্তানকেই লেখাপড়া করাচ্ছেন।

পৃথিবীর অনেক দেশেই, বিশেষ করে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আইন, নীতি, ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে নারীর প্রতি বৈষম্য হতে দেখা যায়। বেশিরভাগ দেশেই নারী এবং মেয়েশিশুরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মঘণ্টাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।

এমনকি ঘর কিংবা বাহির কোনো ক্ষেত্রই এখন পর্যন্ত নারীদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি।

এটা সত্যি, অধিকার অর্জনের বিষয়টি আপেক্ষিক। একেকজনের কাছে এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে, কিন্তু নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সকলেই স্বীকার করেন নারীর অধিকার অর্জনের পথটি ভীষণ কঠিন। একজন হতদরিদ্র নারীর জন্য এখনও তা প্রায় অসম্ভব। কারণ তাকে প্রতিদিন দুবেলা খাবার জোগানোর কথা চিন্তা করতে হয় সবার আগে, তারপর হয়তো বস্ত্র, বাসস্থান, অধিকারসহ অন্য মৌলিক চাহিদাগুলো নিয়ে ভাবার তিনি সুযোগ পান।

এবছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়েছে- “নেতৃত্বে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি” অর্থাৎ পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যেন সমানভাবে নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এবং আশার কথা এই যে, বর্তমানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, বিভিন্ন সংস্থা নারীর প্রতি ঘটে চলা নির্যাতন, হয়রানি এবং বঞ্চনার বিপক্ষে কথা বলছে, কাজ করে চলেছে মানবাধিকার ও লিঙ্গসমতা অর্জনের জন্য।

ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নারীর অধিকার অর্জন ও নারীনেতৃত্ব নিশ্চিতকরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। কারণ ব্র্যাক বিশ্বাস করে, প্রতিটি মানুষই অপার সম্ভাবনার অধিকারী। কেবল প্রয়োজন একটু অনুপ্রেরণার, সঠিক দিকনির্দেশনার। অতিদরিদ্র নারীদের ভাগ্যোন্নয়নে, অধিকার অর্জনে গত ১৯ বছর ধরে এই কাজটিই ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচি করে চলেছে।

সুফিয়ার জীবনের গল্প শুধুই হতাশা আর বঞ্চনার নয়। এই গল্প ঘুরে দাঁড়ানোর, এই গল্প অন্য দুর্ভাগা নারীদের জীবনে আশার আলো জাগানোর। সুফিয়া তার এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, উপজেলা সমাজসেবা অফিসের পক্ষ থেকে নারীদের কল্যাণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন ‘জয়ীতা’ পুরস্কার।

“আজ আমার নিজের একটি পরিচয় আছে, যেটা শুধুই আমার। সমাজে সবাই আমাকে এক নামে চেনে, জানে যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে পাশে পাবে তারা।”

আমাদের দেশের কোনায় কোনায় এমন হাজারও সুফিয়া আছেন, যারা অতিদারিদ্র্য অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন এবং সেখানেই থেমে থাকেননি। অন্য নারীদের ভাগ্যোন্নয়নে, নারী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সোচ্চার হয়েছেন।

 

লেখক ব্র‍্যাকের আল্ট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচিতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments