সাধারণ মানুষের অসাধারণ সফলতা

March 8, 2021

জীবনের বড়ো-ছোটো ঢেউয়ের ভাঙনে ভাসতে ভাসতে অনেকের মতো হারিয়ে যেতে পারতেন কাছমিন জাহানও। কিন্তু লড়াই করে জিততে শেখা কাছমিন হার মানিয়ে দেয় হাজারও পরাজয়ের গল্পকে।

“আমি জীবনে অনেক পরাজিত পুরুষ দেখেছি, কিন্তু কোনো পরাজিত নারী দেখিনি”

– স্যার ফজলে হাসান আবেদ

ত্রিশ বছর আগে কলেজে পড়ার সময় কাছমিনের বিয়ে হয়। স্বামী পুলিশের কর্মকর্তা। বিয়ের পর পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও স্বামী আর তিন বছরের মেয়ে নিয়ে সুখেই ছিলেন কাছমিন।

বিবাহিত জীবন ছয় বছরে গড়ানোর আগেই তিনি বুঝলেন স্বামীর পরকীয়া করছে । প্রেমিকা কাছমিনের আপন চাচাতো বোন। প্রতিবাদ করেন স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু বিনিময়ে মেলে প্রচণ্ড শারীরিক, মানসিক নির্যাতন। তিন বছরের মেয়েসহ এক কাপড়ে ঢাকার বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। এরপর তিনি আশ্রয় নেন জামালপুরে শ্বশুর বাড়িতে। স্বামীর মারধোর, অপমান সব সহ্য করার পরও আশায় ছিলেন স্বামী হয়তো তার কাছে ফিরবে।

তিন মাস পর তালাকনামা পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন কাছমিন। নিজে লেখাপড়া করেননি। রয়েছে শিশুসন্তান, যার দেখভালের দায়িত্ব এখন তাকেই নিতে হবে। কোথায় যাবেন?

বাবার বাড়ি জামালপুরে। ফিরেন সেখানেই। বাবার সাহায্যে আইনের আশ্রয় নেন। বিচারও হয় প্রাক্তন স্বামীর। কিন্তু ফিরে পান না আগের সুখের জীবন।

পরিবারের অন্যদের সহায়তায় কোনো রকমে খেয়ে-না-খেয়ে জীবন কাটতো কাছমিনের। সময়টা ১৯৯৭ সাল। বাবা খাবার দিলে বোনেরা কাপড় দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে যে জীবন কাটবে না তা জানতেন তিনি। মেয়েটাকে মানুষ করতে হবে তার। ঘুরে দাঁড়াতে হবে নিজেকেও।

প্রাণপণে কাজ খুঁজতে থাকেন। পড়ালেখা বা অন্য কোনো বিশেষ কাজ না জানায় খুব চেষ্টা করেও কাজ পাচ্ছিলেন না। সে সময় আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন থেকে কাছমিনের সাথে যোগাযোগ করে তাকে বাড়ি থেকে একটু দূরে একটি সাব-সেন্টারে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। মুহূর্তেই রাজি হন কাছমিন। তবে, তখনও তার জানা নেই আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন কী! আড়ং সম্পর্কেও জানা ছিল না কিছুই।

দুরু দুরু বুকে কাজে গিয়ে জানেন, প্রয়াত আয়েশা আবেদের স্মরণে গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে একটি ফাউন্ডেশন এটি। শহর থেকে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যেকোনো নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ১৯৮৩ সাল থেকে কাজ করছে ফাউন্ডেশনটি। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন আড়ং-এরই একটি অংশ।

কাছমিন কাজ করবেন ফাউন্ডেশনের অন্তর্ভুক্ত সাব-সেন্টারে। যেখানে নানা ধরনের কারুশিল্পের কাজ করা হয়। আড়ং থেকে মোট উপার্জনের ৫০% ব্র্যাকে পাঠানো হয় বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও প্রজেক্টের মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য। আড়ং-এর কারুশিল্পীরা মূলত দুইভাবে উপকৃত হন।

প্রথমটি, নগদ অর্থের মাধ্যমে। আড়ং-এর সকল কর্মীদের যথাসময়ে নিয়মানুসারে অনুমোদিত ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ব্র্যাকের কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে সুযোগসুবিধা পাওয়া যায়। যেমন ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে আর্থিক ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে নিজে বা পরিবারের কেউ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেন।

জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি কর্মসূচি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করে। তারা কারুশিল্পীদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র এবং সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচির আওতাভুক্ত করেন। যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত জীবনেও সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করার দক্ষতা তৈরি হয়।

ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে সন্তানদের বিনামূল্যে উন্নত শিক্ষার সুযোগ পান কারুশিল্পীগণ। ব্র্যাক স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির সহায়তায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা ও নানা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য জানার সুযোগ থাকে। নিয়মিত বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীও দেওয়া হয়। ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচি কারুশিল্পীদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে। এছাড়া ব্র্যাক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে নানা ধরনের হাতের কাজ শেখার সুবিধাও পেয়ে থাকেন কারুশিল্পীরা।

ফাউন্ডেশন থেকে চূড়ান্ত কাজ করার পর সেগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা আড়ং-এর ২১টি আউটলেটে পাঠানো হয়। আড়ং-এর হাত ধরে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে যায় বাংলার ঐতিহ্য।

১৯৯৯ সালের শুরুতে কাছমিন জাহান ফাউন্ডেশনের অন্তর্ভুক্ত কান্তার পাড়া সাব-সেন্টারে কাজ শুরু করেন। শেখার আগ্রহ ছিল খুব। মন দিয়ে কাজ শেখেন। তিন মাস পর কাছমিন বদলি হয়ে যান কলতাপাড়া সাব-সেন্টারে। দায়িত্ব নেন সাব-সেন্টার ইনচার্জ হিসেবে। ১৩টি জেলায় আড়ং-এর ৭০৩টি সাব-সেন্টারে প্রতিটির রয়েছে একজন নারী ইনচার্জ। এখন এই ৭০৩ জনের একজন কাছমিন। ২০১৯ সালের হিসেব অনুসারে, মোট কারুশিল্পী আছেন ৬৫ হাজার জন। যার ৯৭% কারুশিল্পী নারী ।

তার সাব-সেন্টারের চল্লিশজন নারীকর্মীকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবেই ভাবেন কাছমিন। তাদের নিজেদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেন। চেষ্টা করেন তার কারুশিল্পীদের জন্য আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন থেকে নির্ধারিত সুযোগসুবিধা-দক্ষতা ও উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, গ্র্যাচুয়িটি, নিয়মিত চোখ পরীক্ষা, সুরক্ষা সরঞ্জাম, সেইফগার্ডিং ট্রেনিং ইত্যাদি সবকিছুতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে।

কোভিডের সময় আড়ং-এর পক্ষ থেকে কারুশিল্পীদের ৩৪,০২৬,০০০ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কাছমিন তার চল্লিশজন কারুশিল্পীর অনুদানটি প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছেন। কোভিড পরিস্থিতিতে কারুশিল্পীদের সুরক্ষা ট্রেনিং, মাস্ক ও অন্যান্য সরঞ্জামের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে মোট ৩৯,৯৩৩,৪২৪ টাকা অগ্রিম বেতন দেওয়া হয়েছে। কাছমিনের সেন্টারের অনেকে নিয়েছেন সেটি।

সাব-সেন্টারের কারুশিল্পীদের জন্য একটি বিশেষ সুবিধা হলো, তারা চাইলে যেকোনো সময় কাজে যোগ দিতে পারেন। আবার কাজে বিরতি নিতে চাইলে সেটিও পারেন যেকোনো সময়। কাছমিনের জন্য আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, চলে যাওয়া অনেকে আবার কাছমিনের জন্য ফিরে এসেছে। অনেকে আবার কাজ ছেড়ে দিলেও যোগাযোগ বন্ধ করেননি কাছমিনের সাথে। নানা সময় বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ নেন।

কাছমিনও আগলে রাখেন কারুশিল্পীদের। সাব-সেন্টার ইনচার্জ ট্রেনিং-এ নতুন যা কিছু নতুন শেখেন সেন্টারে ফিরে সেসব জানান শিল্পীদের। গত ২১ বছরে ৫০টির বেশি ট্রেনিং পেয়েছেন। যার সুফল হিসেবে উল্লেখ করা যায়, তার সাব-সেন্টারে কোনো বাল্যবিয়ে হয় না।

তবে, কাছমিন যেখানে আছে সেখানে পরিচিতজন বা এলাকাতেও বাল্যবিয়ের সুযোগ নেই। এ পর্যন্ত চারটি বাল্যবিয়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বন্ধ করেছেন। পরোক্ষভাবে বন্ধ করেছেন অসংখ্য। এমনকি কোথাও বাল্যবিয়ের সম্ভাবনা আছে শুনতে পেলেও ছুটে যান পরিবারটিকে সতর্ক ও সচেতন করতে। সহায়তা নিয়েছেন আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাকের জেন্ডার ও জাস্টিস টিমের।

কোনো মেয়ে পারিবারিক সহিংসতার শিকার জানতে পারলে নিজ উদ্যোগে তা বন্ধ করতে চেষ্টা করেন। নিজে বোঝাতে না পারলে কখনো এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পর্যন্ত সহায়তা নেন।

আড়ং প্রতিষ্ঠার পেছনের কারিগর স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বাস করতেন, কাজের ক্ষেত্রে নারীদের অঙ্গীকার এবং আন্তরিকতা অনেক বেশি। নারীদের কাজ দিলে একটি দরিদ্র পরিবার বেঁচে যায়। নারীরা তাদের আয়ের সম্পূর্ণ অংশই পরিবারের পেছনে খরচ করেন। তাঁর আয়ে ছেলেমেয়েরা খেতে পায়, লেখাপড়ার জন্য স্কুলে যেতে পারে।

কথাটি একেবারে মিলে গেছে কাছমিন জাহানের জীবনের সাথে। নিজের উপার্জনেই মিটিয়েছেন মেয়ের থাকা, খাওয়া, হোস্টেলের খরচ সব। পড়ালেখায় করেননি বিন্দুমাত্র আপস। তার ফলও এসেছে খুব মিষ্টি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন কাছমিনের মেয়ে।

কাছমিনের মতো জীবন যুদ্ধে লড়াই করে জয়ী নারীদের আমরা ব্র্যাক পরিবারের পক্ষ থেকে বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments