জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা যেন পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন সেজন্য ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি, সূর্যমুখী চাষ, উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক, বনায়নের মতো বিভিন্ন প্রকল্প।
বাংলাদেশের অবস্থান নিম্ন ব-দ্বীপ অঞ্চলে হওয়ার কারণে এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এর তীব্রতা দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে। বছর জুড়ে নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, আকস্মিক বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন দুর্যোগের ঘনঘটা মানুষের জীবন ও জীবিকাকে করে তুলেছে কঠিন। জার্মান ওয়াচের বৈশ্বিক ঝুঁকি সূচক (জানুয়ারি, ২০২১) অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা যেন পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন সেজন্য ব্র্যাক বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি, সূর্যমুখী চাষ, উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক, বনায়নের মতো বিভিন্ন প্রকল্প। এসব উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে ব্র্যাকের সকল কর্মসূচিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখেই ঢেলে সাজানো হচ্ছে যেন তা হয়ে ওঠে সময়োপযোগী ও কার্যকর।
জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষদের প্রায়ই নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দূরবর্তী কোনো স্থানে ছুটে যেতে হয়। অনেকেই বাড়িঘর ও গবাদি পশু ফেলে রেখে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না। এর ফলে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ে তাদের জীবন। তাছাড়া শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাড়িগুলো প্রায়ই ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। এ সমস্যা সমাধানে ব্র্যাক উদ্ভাবন করেছে জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি।
ব্র্যাকের জলবায়ুসহিষ্ণু বাড়ি ২৫০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড়েও টিকে থাকতে পারে। গত ১০০ বছরেরর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতার কথা বিবেচনায় রেখে বাড়ির ভিটের উচ্চতা নির্ধারণ করে নকশা করা হয়েছে। ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের বাড়িটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি খুব কম খরচেই তৈরি করা যায়। দুইতলা বাড়িটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয় মাত্র সাড়ে ৬ লাখ টাকা।
স্বাভাবিক সময়ে এ বাড়িটি যেমন একটি পরিবারের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা যায় তেমনি জরুরি সময়ে সেটি সাইক্লোন শেল্টারের কাজও করে। আর এজন্যই বাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমার ঘর, আমার আশ্রয়’।
বাড়িগুলোর ভেতরে বন্ধুচুলা, সৌরবিদ্যুৎ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার মতো বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা রয়েছে। এর নিচতলা খালি। সেখানে আছে শৌচাগার, গবাদিপশু ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওঠা-নামার সুবিধার্থে আছে বিশেষ ব্যবস্থা। দ্বিতীয় তলায় আছে দুটি ঘর। ঘরগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে।
সূর্যমুখী চাষ
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে জোয়ারের নোনা পানি ঢুকে পড়ছে। এর ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে কৃষিজমিগুলো হয়ে পড়ছে অনুর্বর। জমিতে ভালো ফলন না হওয়ায় কৃষকেরা জীবিকার সন্ধানে হচ্ছেন শহরমুখী। বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা।
লবণাক্ততা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে অনাবাদি ও পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু সূর্যমুখী চাষে বদলে যেতে শুরু করেছে উপকূলের কৃষিজমিগুলোর চেহারা।
সূর্যমুখী বীজের তেলে ক্ষতিকারক উপাদান বিশেষ করে কোলেস্টেরল কম। এজন্য বাজারে সূর্যমুখীর তেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আর ফলন ভালো হওয়ায় অনেক কৃষকই এখন সূর্যমুখী চাষের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু সূর্যমুখীর চাষ তাই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষি অভিযোজনের এক অনন্য উদাহরণ।
ব্র্যাক কৃষকদের বীজ সহায়তা, চাষ পদ্ধতি, সার ও বালাই ব্যবস্থাপনা এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের ২০০ বিঘা পতিত জমির পাশাপাশি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার বড়দল ইউনিয়নেও করা হচ্ছে সূর্যমুখী ফুলের চাষ।
উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। কোনো কোনো এলাকায় সুপেয় পানি সংগ্রহের জন্য পাড়ি দিতে হয় মাইলের পর মাইল পথ। নিকট ভবিষ্যতে খাবার পানির সংকট হয়তো আরও বাড়বে।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার এর একটি ব্যয়সাশ্রয়ী সমাধান। ব্র্যাক ২০১৯ সাল থেকে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে। এ পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি বিশুদ্ধ ও নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করতে আধুনিক মানের ফিল্টারও যুক্ত করা হয় পানির ট্যাংকের সাথে। এই ফিল্টারে কাপড়ের তৈরি এমন একটি পুনঃব্যবহারযোগ্য ছাঁকনি ব্যবহার করা হয় যা অতি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াকেও আটকাতে সক্ষম। যাদের টিনের চালের ঘর নেই তাদের জন্য রয়েছে বাঁশের খুঁটির ওপরে ত্রিপলের মাধ্যমে বিশেষ পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের স্থানীয় ব্যবস্থাপনা।
অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক
আবাদি জমিগুলো যাতে কোনো ঋতুতেই পতিত না থাকে এবং কৃষিপণ্যের উৎপাদন বজায় থাকে সেজন্য ’অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক’ কাজ করছে।
অ্যাডাপটেশন ক্লিনিকে জলবায়ুসহিষ্ণু বীজ ও ফসল নির্বাচন, বালাই দমন ও সার সংক্রান্ত পরামর্শ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর আগাম বার্তা জানানো, জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার, ফসল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং কৃষকের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বনায়ন
বাংলাদেশে জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনের লক্ষ্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তথা বনায়নে ‘আমার বন’ ও ‘ম্যানগ্রোভ বন’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমার বন হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের এগ্রো ফরেস্ট্রি যেখানে প্রজাতি নির্বাচন এমনভাবে করা হয় যাতে করে সারা বছরজুড়ে ফলন পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত ১১৪টি আমার বন তৈরি করেছে ব্র্যাক। এগুলো পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পশুপাখি, কীটপতঙ্গসহ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবেও ভূমিকা রাখছে।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে ম্যানগ্রোভ বন। বছরে ৮শ টনের বেশি কার্বন শোষণের লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে একটি ম্যানগ্রোভ বন তৈরি করা হয়েছে। ম্যানগ্রোভ বন অন্যান্য স্থলজ বনের চেয়ে ৪ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তাই আমাদেরকে এখনই সচেতন হতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সকলকে একসাথে কাজ শুরু করতে হবে। তবেই আমরা সফল হব, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে পারব এক বাসযোগ্য পৃথিবী।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা, সাব্বির আহমেদ ইমন
কারিগরি সহযোগিতা: ফুয়াদ রাব্বী শুভ্র
Very urgent programed to meet to recovery clime effect country.
Great initiatives to adaptation