জলবায়ু সংকটে বাংলাদেশের উপকূলীয় নারীরা হারাচ্ছে তাদের জরায়ু

November 26, 2023

পানিই জীবন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। বিশেষত যখন এই পানি আপনাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। এটা বাংলাদেশের উপকূলের লাখ লাখ নারীর জীবনের এক চরম বাস্তবতা, যারা জলবায়ু সংকটের ফলে সৃষ্ট সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হন।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মোংলার পশুর নদীর তীর। ১৪ বছর আগের ঘটনা। সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে মাছ ধরার জাল নিয়ে আমি নদীর তীরে গেলাম। প্রতিদিনকার মতো তীর বেয়ে নামলাম পানিতে। সঙ্গে সঙ্গে জ্বালাপোড়া ও চুলকানি শুরু হলো। খুবই বিরক্তিকর!

তখন থেকে দুই বছর আগে আমার বিয়ের সময়ও এখানকার পানি অনেক পরিষ্কার ছিল। নজরুল ইসলামকে (ছদ্মনাম) বিয়ে করে আমি আমার স্বামীর গ্রামের বাড়ি মোংলার এই ছোট্ট জেলেপল্লী চিলা গ্রামে আসি। এখানে আসার দুই বছরের মধ্যে আমার ছেলের জন্ম হয়। একজন জেলের স্ত্রী হিসেবে ধীরে ধীরে আমি এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে পুরোদস্তুর মানিয়ে নিই। যার অর্থ প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা আমাকে নদীতে নেমে গলা পানিতে মাছ ধরতে হতো।

সেদিন পানিতে নেমে সর্বশক্তি দিয়ে আমি জাল আঁকড়ে ধরে হাঁটতে থাকি। আমার হাত এবং মাথাই কেবল পানির ওপরে ছিল। প্রতিদিনই মাছ ধরা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছিল। আমার মনে একটি জিনিসই ঘোরাফেরা করত, রাতের খাবারের চাল কেনার জন্য আমার ৫০  টাকা দরকার। সেজন্য আমাকে অন্তত ওই পরিমাণ টাকার মাছ ধরতে হবে।

জলবায়ু সংকটের কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা তাদের প্রজনন অধিকার হারাচ্ছে

হঠাৎ আমি অনুভব করলাম যে, আমার দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে শরীরের কিছু একটা যেন বেরিয়ে আসছে। ভয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার দিয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। চিৎকার শুনে আমার ননদ এবং শাশুড়ি ছুটে এল। তারা আমাকে পানিতে অসাড় অবস্থায় খুঁজে পেল। তখন হাত-পা ধরে টেনে প্রথমে আমাকে নদীতীরে তুলল। পরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চড়িয়ে নিয়ে গেল পাশের জেটিতে। সেখান থেকে লঞ্চে করে আমরা ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি সরকারি হাসপাতালে গেলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, আমার জরায়ু শরীর থেকে বাইরে বেরিয়েে এসেছে। সেই প্রথম আমি তখন জানতে পারলাম, দূষিত-লবণাক্ত পানিতে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর কারণে আমার এই দশা হয়েছে। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে চলে চিকিৎসা। প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয় এবং পুরো টাকাই আমার আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছিল।

দুর্ভাগ্যের সেই সকালের পর আমার জীবনে পেরিয়ে গেছে ১৪ বছর। কিন্তু কিছুই যেন এখনও বদলায়নি। এখনও আমার চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয় অনেক টাকা। সেই খরচ মেটাতে আমার স্বামী মাছ ধরার নৌকাটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। আট বছর আগে আমি একটি মেয়ে সন্তানের মা হই। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ডাক্তার আমাকে জানান বেঁচে থাকতে হলে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আমার জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। জরায়ু সংক্রমণের শিকার হয়েছে, যা রূপ নিতে পারে ক্যানসারে। অস্ত্রোপচারে ব্যয় হবে ৫০ হাজার টাকা। যা আমার পরিবারের প্রায় দেড় বছরের আয়ের সমান। এই টাকা খরচের সামর্থ্য আমাদের নেই। এদিকে এই শরীর নিয়ে আমাকে এখনও প্রতিদিন মাছ ধরতে যেতে হয়।

ডাক্তার আমাকে বলেছেন, মাসিকের সময় আমি যেন স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করি। কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য এমন পানি কোথায় পাব, যেখানে সামান্য খাবার পানির জন্য আমাদেরকে মাইলের পর মাইল দূরে যেতে হয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় বাস করে। এখানকার নদীগুলো প্রশস্ত ও কাদামাটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীর শাখাপ্রশাখাগুলো ছড়িয়ে থাকে জালের মতো। নদী ভাঙনে প্রতিনিয়ত বদলে যায় মাটি ও পানির সীমানা। মিঠাপানির সঙ্গে এখানে সাগরের কোনো সীমারেখা নেই। প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে জোয়ারের নোনাপানি কয়েক কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে উপকূল ভাসিয়ে দেয়। সেই পানি নামতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ এভাবে পানির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে। নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাদের জীবন ও জীবিকা যেন একাকার হয়ে গেছে!

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও নদীর লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে

বাংলাদেশের মোট ভূমির ২০ ভাগই উপকূলীয় এলাকা। এই এলাকার অর্ধেকেরও বেশি জমি নানা মাত্রায় লবণাক্ত। লবণ পানির এই আগ্রাসন বাংলাদেশে মৌসুমভেদে ভিন্ন রকম হয়। যেমন : জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে লবণাক্ততা সবচেয়ে কম থাকে এবং শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত থাকে সবো‍র্চ্চ।

বাংলাদেশের কিছু উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ এতই বেশি যে সেখানে গভীর নলকূপ থেকেও লবণাক্ত পানি ওঠে

সংকটের প্রধান শিকার নারীই, জলবায়ু সংকটেও ব্যতিক্রম নয়

রিনি বেগম যে এলাকায় বাস করেন, সেই চিলাবাজারে লবণাক্ততা এতটাই তীব্র যে, পুকুর এমনকি ৫-৭শ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও লবণাক্ত পানিই ওঠে। কিছু বাড়ির আঙিনায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য বসানো হয়েছে পানির ট্যাঙ্কি। তবে বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে তা যথেষ্ট নয়।

গ্রামে শুধুমাত্র দুটো বড় পুকুর রয়েছে, যা পুরো গ্রামের মানুষের বিশুদ্ধ খাবার পানির জোগান দেয়। নারী ও শিশুরা প্রতি সপ্তাহে একবার পাত্র নিয়ে সেই পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে। পুকুর দুটোকে এমন যত্নে রাখা হয় যেখানে গোসল বা ধোয়া-মোছা দূরে থাক, পায়ের আঙুল ভেজানোরও অনুমতি মেলে না। শুধুমাত্র খাবার পানির জন্যই এই পুকুরের পানি কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হয়। একে এমন পবিত্র বলে গণ্য করা হয়, যেন মানুষের জন্য এটি একটি স্বর্গীয় উপহার।

এখান থেকে একবারে সংগ্রহ করা পানি দিয়েই চলতে হয় পুরো সপ্তাহ। থালাবাসন ও জামাকাপড় ধোয়া অথবা গোসলে এই পানি খরচ করে ফেললে কমতে থাকবে খাবার পানি। এই এলাকার নারী ও মেয়েরা মাসিকের সময় ন্যাকড়া (পুরনো পাতলা কাপড়) ব্যবহার করে। পানি স্বল্পতার এই চরম বাস্তবতায় তারা নদী থেকে লবণাক্ত পানি নিয়ে সেই ন্যাকড়া ধোয়ার কাজ করে। বছরের পর বছর এটা করার কারণে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য নানা সমস্যার মুখে পড়েছে। যার মধ্যে রয়েছে : জরায়ুর স্থানচ্যুতি, জরায়ু ক্যানসার, পাকস্থলীর দুরারোগ্য নানা সমস্যা এবং ত্বকের বিভিন্ন রোগ।

জেলেপল্লীর মেয়েদের চিকিৎসা সেবা পেতে  ভ্যান, অটোরিকশা এবং ট্রলারে চড়ে ৩০-৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়

চিলাবাজারের এই চিত্র বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের গ্রামগুলোর একটি সাধারণ ঘটনা, যেখানে নারীরাই প্রধান শিকার। তাদেরকে মাসিকের সময়, মাতৃত্বকালে এবং প্রসবোত্তর সময়ে নানা সমস্যায় ভুগতে হয়। ফলে বাড়ছে গর্ভপাত এবং শিশুমৃত্যুর হার। এখানে বাস করা ছোট জেলেপল্লীর মানুষ যথাযথ চিকিৎসা সেবা পায় না, নেওয়ার সামর্থ্যও তাদের নেই।

লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত এই সমস্যা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বাংলাদেশের উপকূলের তরুণীরা জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ খেয়ে তাদের মাসিক বন্ধ রাখছে। কেবল বেঁচে থাকার জন্য ৩০-৪০ বছর বয়সেই বহু নারী অস্ত্রোপচার করে তাদের জরায়ু ফেলে দিচ্ছে। এটি করার সামর্থ্যও অনেকের নেই।

যাদের সামর্থ্য নেই, তারা ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে এগোয়  

অস্ত্রোপচার, চিকিৎসা, ওষুধ, পরিচর্যা মিলিয়ে মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৫শ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৫ হাজার)-এর মতো। এখানকার মানুষের দৈনিক গড় আয় ১-৩ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১১০ থেকে ৩৩০ টাকা)। এই এলাকার মানুষ সরকারি হাসপাতালের সেবা পেতে ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাট বা খুলনা শহরে যেতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যদিও সেখানে যাওয়ার খরচ তাদের দৈনন্দিন আয়ের চেয়ে বেশি। কাছাকাছি মোংলায় হাসপাতাল থাকলেও সেখানে সেবার মান ভালো নয়। রিনির মতো কোনো কোনো পরিবার তাদের একমাত্র সম্পদ বিক্রি করে ফেলছে। অনেকের ক্ষেত্রেই সেই সম্পদ হচ্ছে জীবিকার উৎস নৌকা, যা হারাতে হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসাসেবা পাওয়ার জন্য।

বাংলাদেশে প্রায় ১ দশমিক ০৫৬ মিলিয়ন হেক্টর (২.৬ মিলিয়ন একর) চাষযোগ্য জমি নানা মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এই জমির আয়তন প্রায় লেবানন-এর সমান। মোংলার স্থানীয় অধিবাসীদের মতে, তাদেরকে বছরে প্রায় ছয়মাসের মতো লবণাক্ততাকে মোকাবিলা করতে হতো। তবে গত ৫ বছরে এই চিত্র অনেকটাই পাল্টেছে। এখন প্রায় ৯ মাস নানা মাত্রার লবণাক্ততা চলতে থাকে। বছরে মাত্র ৩ মাসের একটি বিরতি রয়েছে, যখন বর্ষাকালে ব্যবহারের জন্য মিঠা পানি পাওয়া যায়। প্রতি বছর এই সময় একটু একটু করে কমছে। ক্রম নিষ্ক্রিয়তা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের ফলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে সেটা দুর্যোগে রূপ নিচ্ছে।

প্রজনন অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম। জলবায়ু সংকট নারীদের সেই অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। উন্নত বিশ্বের মানুষ যখন প্লাস্টিক স্ট্র থেকে ধাতব স্ট্রতে যাওয়ার মতো ছোটখাট ঝামেলা নিয়ে লড়াই করছে, তখন এই প্রান্তিক নারীদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার সংকট নিয়ে লড়তে হচ্ছে। রিনি তার জীবনে জীবাশ্ম জ্বালানির সুবিধা কদাচিৎ নিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি এর সবচাইতে মারাত্মক শিকার। বাংলাদেশসহ দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার মতো লাখ লাখ নারী এখন অন্য মানুষের চাওয়া-পাওয়ার চড়া মূল্য পরিশোধ করছেন।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ধাপে ধাপে যে সব সামগ্রী প্রয়োজন, তা কেনার জন্য সাড়ে ৩শ ডলার ব্যয় করতে হয় (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৮ হাজার ৫শ টাকা)। আমরা জানি কীভাবে তা তৈরি করতে হয়। কিন্তু এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান নেই। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অর্থের মাত্র ৩ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। এই অর্থের মাত্র ৬ শতাংশ ব্যয়িত হয় স্থানীয়ভাবে পরিচালিত প্রকল্পে।

 

সম্পাদকের নোট : ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার্থে রিনি বেগম ছদ্মনামটি ব্যবহার করা হয়েছে। 

অনুবাদক : সুলাইমান নিলয়

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
sabira chowdhury
sabira chowdhury
5 months ago

What an insightful report ! my sincere thanks to the reporter for portraying the affect of the climate change. I feel so sad to know this towards the vulnerable girls and women who are direct victim, I wish we can negotiate more and save the victims.

mahbuba
4 months ago

These are the problems no one knows about. Thanks for sharing.
https://mahbubabethi.com/