১৯৭৪ সালের কথা, রংপুরের রৌমারিতে সেবছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। আবেদ ভাই সেখানে ব্র্যাকের ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা করতে গিয়ে নারীর অবস্থান এবং তাদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির এক বিপরীত সত্য আবিষ্কার করেন। জয়বানুর জীবনসংগ্রাম এর বাস্তব উদাহরণ!
“আমি জীবনে বহু পরাজিত পুরুষ দেখেছি,
কিন্তু কখনও পরাজিত কোনো নারীকে দেখিনি।”
– স্যার ফজলে হাসান আবেদ
জয়বানু থাকেন মুন্সীগঞ্জের টংগীবাড়ির উত্তর মাহাকাশি গ্রামে। তার স্বামী আসলাম খলিফা অন্যের নৌকায় মাঝির কাজ করতেন। ছোটো একটা ঘরে তিন সন্তান নিয়ে কোনোরকমে থাকা আর সামান্য কিছু আয়ে টানাপোড়েনের সংসার-এই তো তার জীবনের গল্প। কখনও খাবারের অভাব আবার কখনও থাকার কষ্ট।
জোড়াতালি দেওয়া বেড়ার ঘর একটা আছে বটে, সেখানে অন্য সব মাস যেমন-তেমন; শীত আর বর্ষায় যে কী কষ্ট!
জীবনের এত দুঃসময়েও কখনও আশা হারাননি জয়বানু। সংসারের অভাব-অনটনের কথা ভেবে তার স্বামী বারবার হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন, কিন্তু তিনি সবসময় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। স্বামীকে তিনিই সবসময় বলতেন, দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার সংসারে একদিন সুদিন আসবেই।
১৯৭৪ সালের কথা, রংপুরের রৌমারিতে সেবছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেখানকার বেশিরভাগ পরিবারে সেসময় দৃশ্যটা ছিল এরকম- বাড়ির পুরুষ সদস্যরা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের রেখে কাজের খোঁজে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে। টাকা আয় করতে পারেননি তাই ফিরেও আসেননি। সংসার দেখার পুরো দায়িত্ব তখন এসে পড়ত বাড়ির নারীদের ওপর। কিন্তু এই বিপদেও কোনো মা তার সন্তানদের ফেলে চলে যেতে পারেননি। তিনি সেখানে থেকেই কোনো না কোনোভাবে খাবার জোটানোর চেষ্টা করে গেছেন।
আবেদ ভাই রৌমরিতে ব্র্যাকের ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা করতে গিয়ে নারীর অবস্থান এবং তাদের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির এই বিপরীত সত্য আবিষ্কার করেন। তিনি বলেন, “আমি নিশ্চিতরূপেই দেখেছি, মহিলারা নিজেদের পরিবারের প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল। এজন্যই মহিলাদের সংগঠিত করে তাদের আয়ের ব্যবস্থার কথা সবসময় ভেবেছি।”
জয়বানুর জীবনসংগ্রাম এর বাস্তব উদাহরণ!
জয়বানু প্রথমে ভেবেছিলেন জমি বর্গা নিয়ে নিজেই চাষাবাদ করবেন। এজন্য কত জনের কাছে টাকা ধার চাইলেন কিন্তু কেউ টাকা দিল না। সবাই হয়তো ভেবেছিল জয়বানু ধারের টাকা ফেরত দিতে পারবে না। জামানত দিয়ে টাকা নেওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না তার। একদিন তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে ব্র্যাকের জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি।
ব্র্যাক থেকে পনেরো হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি একটি আবাদি জমি বর্গা নেন। এরপর নিজেই চাষাবাদ করেন। তিনি শাকসবজি আর মৌসুমি ফসলের চাষ করেন। শুরু হলো তার দিন বদলের গল্প। এই প্রথম দূর হলো সংসারে খাবারের অভাব।
ফসল বিক্রির আয় পুরোটাই কিন্তু তিনি সংসারে খরচ করেননি। কিছু কিছু সঞ্চয় করতেন। একসাথে বেশ কিছু টাকা জমা হলে তিনি সেই টাকায় গরু কিনলেন। জমি চাষ এবং গরু পালন নিয়ে দিন দিন কাজের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে জয়বানুর।
নিজের টাকায় দুটি দোচালা টিনের ঘর তুলেছেন জয়বানু। শীত কিংবা বর্ষায় এখন আর কষ্ট করতে হয় না। দুই ছেলেকে কাজ করতে বিদেশে পাঠিয়েছেন। একজন দুবাই, আরেকজন থাকে কাতারে। ছোটো মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।
জয়বানুর স্বামী এখন মাঝির কাজ ছেড়ে মুদি দোকান সামলান। মাস দুয়েক আগে আঠারো লক্ষ টাকা দিয়ে আবার নতুন একটি জমি কিনেছেন তিনি।
ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি তার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প সেদিন সবাইকে শুনিয়েছেন। তার প্রত্যাশা অন্যরাও তার মতো একদিন স্বাবলম্বী হবে। উত্তর মাহাকাশির অসংখ্য নারীর কাছে হার না-মানার লড়াইয়ে জয়বানু আজ এক অনুপ্রেরণার নাম।
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা
গল্প সংগ্রহে- সুহৃদ স্বাগত