ঝুমার পড়ালেখা চলে পানিতে। একটি হালকা নীল রংয়ের মাঝারি আকারের নৌকায় তারই মত আরও ২৫ জন। স্কুল আসে ঝুমার বাড়িতে। তার কোথাও যেতে হয় না; নদীতে ভেসে ভেসে চলে পড়ালেখা। আবার স্কুলই তাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়।
এবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি থামবার কোন লক্ষণই নেই। সেই বৃষ্টির মধ্যেই নৌকাটি ধীরে ধীরে ভেসে চলে, আর তার ভেতরে ঝুমা ও তার বন্ধুরা কখনও ব্যস্ত অংক নিয়ে, কখনও ইংরেজি নিয়ে। সুনামগঞ্জ জেলায় ঝুমার বাস, যেখানে বন্যার প্রকোপে অনেক মানুষই নিরাপদ আশ্রয় এবং কাজের খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন। তাদের মধ্যে আছেন ঝুমার মা এবং বড় ভাই। ঝুমা তার বাবার সাথে রয়ে গেছে গ্রামেই। অথবা এভাবে বলা ভালো যে, ঝুমার বাবাই ঝুমার সাথে গ্রামে থেকে গেছেন। ১০ বছরের ঝুমার দু’মাস বাদে পরীক্ষা, তাই সে প্রস্তুতির জন্য গ্রামে থেকে যেতে চায়। পড়াশোনা তাকে চালিয়েই যেতে হবে।
এক টুকরো জমির ওপর ছোট একটি মাটির ঘরে ঝুমা তার পরিবারের সাথে বাস করে। দেশের এই এলাকা বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে থাকে পানির নিচে। হাওর এলাকায় ৭ জেলা মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস। স্কুল থেকে ঝরে যাওয়ার হার এখানেই সবচেয়ে বেশি। শতকরা মাত্র ১%, বা তারও কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এখানে মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো ভয়াবহভাবে আমাদের সামনে ফুটে উঠছে। প্রতি বছরই আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে আবহাওয়ার আচরণ। অনেক স্কুল বন্ধ থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলে যাওয়ার রাস্তাগুলো হয়ে পড়ে মেরামতের অযোগ্য। কাজের অভাবে পরিবারগুলোর আয় কমে আসে। তাই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। বন্ধ হয়ে যায় তাদের পড়াশোনা।
অনেকেই বলছেন যে ১৯৮৮ সালের পর এ বছরের বন্যাই সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশের এক-তৃতীয়াংশই পানির নিচে। ১৬ জেলায় প্রায় ৪,০০০ স্কুল এখন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৬ লক্ষ শিক্ষার্থীর এই বন্যার কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যার এই ভয়াবহতা ভবিষ্যতে বহুগুণ বাড়ার সম্ভাবনা আছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে এমন ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
এখানেই মূল চ্যালেঞ্জ।
তারা স্কুলে যাবে কি করে যদি তাদের কোন রাস্তাই না থাকে? শিখবেই বা কি করে যদি ক্লাস পানিতে ভেসে যায়?
তাই প্রশ্ন এলো, ক্লাসরুমগুলোকেই যদি হাওরের পানিতে ভাসিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌছে দেয়া যায় তবে কেমন হয়?
স্কুল বলতে এখন ওই নীল নৌকাটাই এই মুহূর্তে ঝুমার মত আরও অনেক শিক্ষার্থীর একমাত্র ভরসা। যত ঝড়বৃষ্টি বা বন্যা হোক না কেন, নীল নৌকাটা থাকে ভাসমান, সাথে লেখাপড়াও থাকে চলমান। চলাচলের অনুপযোগী রাস্তা যেখানে, সেখানে নিরাপদে এই নৌকাটি শিক্ষার্থীদের বাড়ি পৌছে দেয়।
২০১১ সালে প্রথম ব্র্যাকের এই শিক্ষাতরী কর্মসূচি শুরু হয় বাংলাদেশের হাওর এলাকায়। প্রথম পরীক্ষামূলক নৌকাটিতে ৩০ জন শিক্ষার্থীর বসবার ব্যবস্থা ছিল। এরপর নৌকাগুলো আরও উন্নত হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়, ছাদেও ব্যবস্থা করা হয় আসনের। এমনকি এক কোণে যত্ন সহকারে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য ছোট একটি জায়গাও তৈরি করা হয়।
শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার একটি সমাধান হিসেবে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। হাওর এলাকায় কয়েকটি নৌকা দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়ে পরবর্তীতে তা দেশের প্রত্যন্ত, দুর্গম এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। রংপুর, রাঙ্গামাটি, সিরাজগঞ্জ এবং আরও কিছু জেলায় ৫০০টি শিক্ষাতরী এই মুহূর্তে বছরজুড়ে প্রায় ১৪,০০০ শিক্ষার্থীর মাঝে শিক্ষা বিতরণ করে থাকে।
এই ভাসমান ক্লাসরুম কর্মসূচি ফিলিপাইনেও পরিচালিত হচ্ছে। দেশটির মিন্দানাও অঞ্চলে প্রথম ২০১৪ সালে এই কর্মসূচি শুরু হয়। এই স্কুলগুলো মিন্দানাও অঞ্চলের দ্বীপগুলোর অধিবাসী বাজদাও সম্প্রদায়ের কাছে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম। ‘বাদজাও’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা ‘সমুদ্রের জিপসি’ হিসেবে পরিচিত। তারা সমুদ্রে মাছ ধরে এবং শৈবাল চাষ করে জীবনধারণ করে। অনেক বছর ধরে উপকূল এলাকার এই বাসিন্দারা শিক্ষা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত। তবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। এখন প্রতিদিন ভোরবেলা ‘বাজদাও’ সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোরেরা প্রথমে ঘুম থেকে উঠে পরিবারের সাথে মাছ ধরতে যায়, এরপর তারা বন্দরের কাছাকাছি ভেড়ানো শিক্ষাতরীর পথে দলবেঁধে রওনা দেয়। প্রায় ২০০-এর অধিক ছাত্রছাত্রী ৭টি শিক্ষাতরীতে পড়াশোনা করে। নৌকাগুলো আমাদের দেশের মত একই সামগ্রী দিয়েই তৈরি।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে, শিক্ষাক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি সবচেয়ে ভয়াবহ। এ ধরণের চ্যালেঞ্জ কেউ আগে কখনও মোকাবেলা করেনি। তবে এটাও সত্য, একযোগে যদি আমরা সকলে কাজ করি, তাহলে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা এখন সবসময়ের থেকে বেশি প্রস্তুত।
যে কোন সংকট বা দূর্যোগে, আমাদের সন্তানদের যদি ক্লাসরুম পর্যন্ত পৌছানোর আর কোন উপায় না থাকে, তবে আমাদের শিক্ষাতরী ওদের কাছে পৌছে যাক।