মঞ্জু রানী অন্যায়ের প্রতিবাদে কখনও পিছপা হননি। নিজের পরিবারে তো নয়ই। একবার তার ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয়া যখন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলেন তখন তিনি ও তার স্বামী প্রতিবাদ করেছেন। তার অধিকারের বিষয়ে তাকে জানিয়েছেন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় সালিশের ব্যবস্থাও তিনি নিজেই করেন।
আগের সপ্তাহে নাড়ু বানিয়েছিলেন মঞ্জু দিদি। মাটির রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা পাকা রাস্তা, তার উপর দিয়েই নেতৃসুলভ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে নিজের বাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে তিনি বলছিলেন- নাড়ু গতকাল পর্যন্ত ছিল। আমরা আজ আসব আগে জানলে তিনি রেখে দিতেন। এর পরের বার আসলে যেন আগে থেকে তাকে জানিয়ে আসি। অফিসের ভাইরা এসেছি তার বাড়িতে, অথচ নাড়ু খাওয়াতে পারলেন না, এই নিয়ে আফসোস করলেন পরিচয়ের প্রথম ৫ মিনিট।
মঞ্জু রানী দাশের সঙ্গে ব্র্যাকের প্রথম পরিচয় হয় তার জীবনের আর্থিক সংকটের এক সময়ে, কিস্তি ঋণের গ্রাহক হিসেবে। সেই পরিচয়টা কেন দেরিতে হয়েছিল তা নিয়ে হয়তো তার আফসোস থাকতে পারে, কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে কোনো আফসোস আজ করেন না মঞ্জু রানী। বরং একজন আশাবাদী মানুষ হিসেবে অন্যদের, বিশেষ করে নিজের এবং আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার নারীদের জীবনের সুখদুঃখ নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কেটে যায় তার দিন।
মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে তার ব্র্যাককে চেনা। মাত্র ৫ টাকা সঞ্চয় দিয়ে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ঋণ নিয়ে কিনেছেন সেলাই মেশিন। যে মেশিন দিয়ে তিনি আজও কাজ করেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতান কর্মসূচি (সিইপি) পরিচালিত পল্লীসমাজের একজন সভাপ্রধান। মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচির (এইচআরএলএস) আইন সেবিকা হিসেবেও কাজ করেছেন। এখনও যুক্ত আছেন মাইক্রোফাইন্যান্সের গ্রাম সংগঠনের সঙ্গে।
ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিকের গ্রাম সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন তার মা। সে বহুকাল আগের কথা। মা দাবি প্রকল্পের সভানেত্রী হিসেবে কিস্তি গ্রাহকদের নেতৃত্ব দিতেন, তার মৃত্যুর পর থেকে মঞ্জু রানী আজ প্রায় ২২ বছর ধরে এই দায়িত্বসহ আরও বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মৌলভীবাজার সদরে চাঁদনীঘাট এলাকায় মঞ্জু রানী দাশের বাড়ি। নিজ এলাকার জনগণের প্রয়োজনে তিনি সম্মুখ সারির যোদ্ধা। পল্লীসমাজের সভাপ্রধান হিসেবে তো বটেই, একজন পরোপকারী মানুষ হিসেবে যে কোনো দুর্যোগে সাড়াদানকারী প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনিই সবসময় এগিয়ে আসেন। সেইসঙ্গে মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সাথে। সেটি এখনকার সময়ের এই মহামারি বিষয়ে হোক, বা হোক মানুষের অধিকার নিয়ে।
যখনই কথা বলেন, হাসিমুখেই কথা বলেন মঞ্জু দিদি। তাকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোবাসেন কেন? খুবই মজার ভঙ্গিতে তিনি হেসে বলেন, “দেখেন ভাই, মানুষকে বোঝাতে চাই যে আমি ছোটোখাটো দেখতে হতে পারি, কিন্তু আমার মনটা অনেক বড়ো!”
গ্রাম সংগঠনের সদস্যদের খোঁজখবর রাখা, বিপদেআপদে সহায়তা দান, ঋণ গ্রাহককে সুযোগসুবিধা সম্পর্কে জানানো, ঝগড়া-সালিশে আইনি সহায়তা লাভে সাহায্য করা, নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে সদস্যদের উৎসাহিত করা- এমন নানা কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকেন তিনি। করোনা মহামারির এই সময়ে জনগণকে সচেতন করতে, মাস্ক পরার কথা এখনও বলে চলেছেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে।
তিনি একাধারে প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন। ব্র্যাকের কমিউনিটি রেডিও স্টেশন রেডিও পল্লীকণ্ঠের সচেতনামূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন। দরিদ্র নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের পরামর্শক হিসেবেও আছেন তিনি। বাল্যবিবাহ এবং পারিবারিক নির্যাতনের মতো অনেক ক্ষতিকর সম্পর্কেও তিনি মানুষকে বুঝিয়েছেন।
হতদরিদ্র প্রতিবেশী লক্ষ্মী রানীর কথা তিনি বারবার বলেন। ব্র্যাক থেকে প্রশিক্ষণ নিতে মঞ্জু দিদি তাকে উৎসাহিত করেছেন। এরপর লক্ষ্মী রানী ঋণ পেয়ে গাভি কিনেছেন, তার অবস্থাও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তিনি এখন সুখী-সুন্দর নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেন। এমনিভাবে কাউকে ঠোঙা বানানো কিংবা মোমবাতি বানানো বা সেলাই ইত্যাদি নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, আবার একই সঙ্গে কাউকে ঋণের সুযোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে তিনি দরিদ্র নারীদের উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
অনেককে আবার তার সেলাই কাজের সঙ্গে যুক্ত করছেন। সবাই মিলে ভালো থাকার স্বপ্নটা তিনি দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে চান।
মঞ্জু রানী মানুষের পাশে থাকেন কারণ অভাবের কষ্টটা তিনি বোঝেন। অভাবের কষ্ট তার সংসারেও আছে। ছেলে কলেজে পড়ে, মেয়েও স্কুলে পড়ালেখা করছে। সেই খরচ তো কম নয়। তবে তিনি নিজেও যা আয় করেন- তাতে সংসারে অনেক সাহায্য হয়। অন্যের স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন স্বামী। তাই তার সঙ্গে কেবল আরেকটু আয় যোগ হলেই ভালো থাকা যায়। সন্তানদের লেখাপড়ার মূল খরচ স্বামী দিলেও অন্য নানা খরচে তিনি সাহায্য করেন।
এইচআরএলএস-এর আইনসেবিকা হিসেবে ৮ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে নারীদের জন্য ২২ দিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন মঞ্জু রানী। গ্রামের নারীদের তিনি আগেই জানিয়ে রাখতেন কবে ব্র্যাক অফিসে থাকবেন। এখনও অনেককেই ভরসা দেন এই বলে যে, কোনো আইনি সমস্যা সম্পর্কে তাকে জানালে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যাবেন।
মঞ্জু রানী অন্যায়ের প্রতিবাদে কখনও পিছপা হননি। নিজের পরিবারে তো নয়ই। একবার তার ঘনিষ্ঠ একজন আত্মীয়া যখন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলেন তখন তিনি ও তার স্বামী প্রতিবাদ করেছেন। তার অধিকারের বিষয়ে তাকে জানিয়েছেন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহায়তায় সালিশের ব্যবস্থাও তিনি নিজেই করেন।
ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য তার লড়াই কখনও থামবে না।
মঞ্জু রানী মনে করেন, যদি তরুণীদের পাশাপাশি দেশজুড়ে বয়স্ক নারীদেরও আয়বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে তারাও স্বাধীনভাবে নিজেদের উপার্জনে ভালো থাকতে পারবেন। মঞ্জু রানী র ছেলে পল্লীসমাজের সদস্যের সন্তান হিসেবে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রশিক্ষণ পেয়েছে, সেইসঙ্গে পেয়েছে ব্র্যাক থেকে অর্থ সহায়তা। পল্লীসমাজ ব্র্যাকের অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ফলে তারা নিজেরাই ভালো থাকার উপায় বের করে নিতে পারে।
ছেলেবেলায় তিনি মাঝে মাঝে নিজে যা শিখতেন, তাই-ই অন্যদের পড়াতেন। তাই তার শিক্ষিকার পরিচয়টি আজও মুছে যায়নি। এলাকায় তিনি এখনও মাস্টার হিসেবে পরিচিত! ব্র্যাকের কল্যাণে আজ অনেক মানুষ তাকে আপদেবিপদে ডাকে, ভরসা করে, ভালোবাসে মন থেকে। মঞ্জু রানী বলেন, “যখন শুনি কেউ বলে, নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখো নাহলে আমাদের সাহায্য করবা কীভাবে? এই যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আমাকে সব কাজে ডাকে- এ কথা মনে হলে আমার গর্ব হয়।”
মঞ্জু রানীর মতো সুন্দর হৃদয়ের মানুষদের কারণেই দিনশেষে অনেক নারী স্বপ্ন দেখেন, নিজের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তি এবং অনুপ্রেরণা পান। সমাজের যে অন্ধকার এবং বৈষম্য দূর করতে আমরা একযোগে কাজ করছি, সেই অগ্রযাত্রায় সবার সামনে থাকেন মঞ্জু রানীরাই।
সহযোগিতায়- তারিক আজিজ