কড়াইল বস্তির পুরোটাই আমাদের দেখভাল করতে হয়। এখানকার মানুষেরা আমার কথা শোনেন, মানেন এবং বিশ্বাসও করেন। ড্রেন এবং রাস্তা তৈরির মতো কাজে সহযোগিতা করায় বস্তিতে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাস যেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে তা ভীতিকর। তবে মানবতার সেবা শ্রেষ্ঠ সেবা এবং এই সেবায় আমার কোনো ক্লান্তি নেই, নেই কোনো ভয়।
শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ও ভুল তথ্য জানার কারণে ঢাকায় বস্তিবাসীদের মধ্যে অনেকেই ভয় পেয়েছিলেন। তারা যখন আমাদের মাস্ক, গ্লাভস ও এপ্রোন পরে আসতে দেখতেন তখন বারবার সন্দেহ নিয়ে তাকাতেন। অনেকেই বলেছেন, আমরাই ভাইরাস নিয়ে আসছি কি না? তাদেরকে বোঝাতে হয়, আশ্বস্ত করতে হয় যে সচেতন করতে এবং রোগের ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা নিয়ে কথা বলতেই আমরা এসেছি।
কড়াইল বস্তিতে অনেক মানুষের বাস। কেউই কিন্তু কোনোভাবেই এই বাসস্থান ছেড়ে যেতে চান না। আমি তাদের বলি যে, এটা তাদের এলাকা, বলা যায় আমরাই বাইরের লোক। জিজ্ঞেস করি, ‘প্রতিবেশী এবং পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখতে আপনার সচেতন হওয়ার কি প্রয়োজন নাই?’
আমি প্রায় তিন বছর ধরে ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে কাজ করছি। যে টিমের দায়িত্বে আছি, তার তিনজন সদস্য। সবাই কঠোর পরিশ্রমী। কড়াইল বস্তির পুরোটাই আমাদের দেখভাল করতে হয়। এখানকার মানুষেরা আমার কথা শোনেন, মানেন এবং বিশ্বাসও করেন। ড্রেন এবং রাস্তা তৈরির মতো কাজে সহযোগিতা করার ফলে বস্তিতে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।
করোনার শুরুর দিনের কথাতেই আবার ফিরে আসা যাক। আমার কাছে এক গর্ভবতী মা এলেন। তার চোখে-মুখে ভয় আর আতংকের ছায়া। তিনি জানালেন, তার গলাব্যথা, সঙ্গে কাশিও আছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মা হতে চলছেন, কাজেই তার এ অবস্থায় আমিও বেশ নার্ভাস হয়ে পড়লাম। তাকে পরামর্শ দিলাম, যেন দেরি না করে কাছেই মহাখালীর কোনো হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখান।
গর্ভাবস্থার এই শেষ সময়ে তিনি কোনো ঝুঁকিতে পড়ুন, তা চাচ্ছিলাম না। আমার কথা শুনে তিনি ডাক্তার দেখাতে দেরি করেননি। ডাক্তার তাকে জানিয়েছেন ভয়ের কিছু নেই, তিনি সুস্থ আছেন। তবে তার এ অবস্থায় নিরাপদে থাকা উচিত। বাড়িতে থাকতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।
এ দু-একদিন পর আমি বস্তির ঘরে ঘরে গিয়েছিলাম মানুষের অবস্থা নিজে দেখে আসতে। তবে সদস্যদের নিয়ে আমাদের কোনো বৈঠক হয়নি, আমরা নিয়ম মেনে ৩ ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলেছি। আমি সেই গর্ভবতী মায়েরও নিজে থেকেই খোঁজ-খবর নিতে যাই। শরীর কেমন আছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন যে ডাক্তার বুঝিয়ে বলার পর এখন আর তার ভয় করছে না। সেদিন পরামর্শ দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। আমিও খুশি, যাক কোনোভাবে তো অন্তত আমি তার কাজে আসলাম!
আমি তাদের বোঝাই, কেন বাইরে থেকে ফিরে আসার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে বা সামাজিক দূরত্ব মানে কতোটুকু দূরে থাকতে হবে বা কেন বারবার হাত ধোয়া উচিত। এ সংক্রান্ত লিফলেট এবং স্টিকারগুলোও আমরা বিতরণ করছি।
নিরাপদ থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করি আমরা। চেষ্টা করছি যতজনকে সম্ভব নিরাপদ রাখার। নিজের ব্যাগে সবসময় স্যানিটাইজার, মাস্ক এবং গ্লাভস রাখি। কাজের জন্য বের হই, বাড়ি ফিরেই প্রথমে গোসল করি। মহামারির কারণে আমার বাড়িওয়ালা কাউকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছেন না। আমি তাকে ব্র্যাকের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্যের কাগজপত্র দেখিয়েছি, এরপর তিনি রাজি হয়েছেন।
এভাবেই কাটছে আমার করোনার দিনগুলি। সবাই আশা করছি, এই দুর্যোগ যেন দ্রুত কেটে যায়। আমরা যেন ফিরতে সবাই আমাদের পরিচিত এবং স্বাভাবিক জীবনে।
অনুলিখন ও সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা
সাক্ষাৎকার- তৌসিফ ফরহাদ