খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। চিন্তায় সৎ থেকে দেশের জন্য যেটা ভালো মনে হতো তিনি সেটাই সবসময় করে গেছেন। স্বাস্থ্যখাতের জন্য ভালো কিছু করার জন্য তিনি ছিলেন সবসময় একরোখা, কিন্তু নিজ আদর্শে অটল। তাঁর ওষুধ নীতি বাংলাদেশের ওষুধ খাতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে।
না ফেরার দেশে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর মৃত্যু একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন! নশ্বর এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও প্রস্থানের মধ্যকার সময়কে বলা হয় ‘জীবন’। সেই জীবনে কে কী করলেন, কী রেখে গেলেন সেটিই কিন্তু মূল বিবেচ্য। মহত্ত্ব ও সার্থকতা প্রতিটি মানুষের কর্মের মধ্যেই নিহিত থাকে। জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝের ‘জীবন’ নামক অংশটির অবসানের মধ্য দিয়ে তিনি ধরণী থেকে বিদায় নিয়েছেন। হয়তো থেমে গেল তাঁর কর্ম, তাঁর এগিয়ে চলা। কিন্তু থেকে গেল তাঁর ত্যাগ, দেশপ্রেম, মানবসেবা এবং সত্যচারিতা, যা চিরদিন অমলিন হয়েই রইবে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মেধা, মনন ও কর্মে একজন মহান ও সার্থক মানুষ হিসেবেই সকলের হৃদয়ে চিরজাগরূক হয়ে রইবেন।
১৯৪১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম । বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজারের নবকুমার স্কুলে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপরের গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে আলোচিত হয়েছিলেন এবং করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন। পরে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন। ইংল্যান্ডে থাকার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ভারতে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন এবং সহযোগীদের সঙ্গে মিলে সেখানেই মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যজ্ঞান দান করেন, যা দিয়ে তারা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতেন। তাঁর এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়।
সেই যুদ্ধ হাসপাতালই স্বাধীন বাংলাদেশে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার একটি ভিন্ন মডেল তিনি দাঁড় করিয়েছেন, যা তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। তিনি শুধু নিজেকেই দেশের সেবায় নিয়োজিত করেননি, উদ্বুদ্ধ করেছেন আরও বহু মানুষকে। বর্তমান বাংলাদেশের নানা ক্ষেত্রের উজ্জ্বল অনেক মানুষই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রেরণা ও উৎসাহে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। উল্লেখ্য, বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএমএ)-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং তাঁর ছিল বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
১৯৭২ সাল থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনাকে জনগণতান্ত্রিক করার সংগ্রামে যুক্ত হন। তাঁর ঐকান্তিক প্রয়াসে ১৯৮২ সালে দেশে ওষুধনীতি প্রণীত হয়। বৈশ্বিকভাবে বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য সব ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত চিকিৎসকের দরকার নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যে স্বল্পশিক্ষিত প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব–এই ধারণাটি তাঁর উদ্যোগের কারণেই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়।
খুবই সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতি করলেও পরবর্তী জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি। কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত না হলেও রাজনীতি সচেতন ছিলেন। সবসময়ই স্বাধীন রাজনৈতিক মতামতের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘আমি মানুষের রাজনীতি করি।’ চিন্তায় সৎ থেকে দেশের জন্য যেটা ভালো মনে হতো তিনি সেটাই সবসময় করে গেছেন। তখন থেকেই স্বাস্থ্যখাতের জন্য ভালো কিছু করার জন্য তিনি ছিলেন সবসময় একরোখা, কিন্তু নিজ আদর্শে অটল। তাঁর ওষুধ নীতি বাংলাদেশের ওষুধ খাতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। বিশেষ করে এর জন্যই বর্তমান বাংলাদেশে ওষুধ খাতের এতো উদ্যোক্তা।
অন্য প্রসঙ্গে একটু বলি। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছিল দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আবেদ ভাইয়ের হঠাৎ জীবনাবসানে তিনি যারপরনাই ব্যথিত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মৃত আবেদ ভাইকে চিন্তা করি না, আমি জীবন্ত আবেদ ভাইকেই মনে রাখতে চাই।’
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে আবেদ ভাই স্মরণে অনুষ্ঠিত হয় ‘সেলিব্রেটিং দ্য লাইফ অ্যান্ড লিগ্যাসি অব স্যার ফজলে হাসান আবেদ’। এ আয়োজনে অনেকের মধ্যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও স্মৃতিচারণ করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আবেদ ভাই আমার বড় ভাই এবং বন্ধু। আবেদ ভাই অঙ্কের জগতের মানুষ। আমি এমন একটি পেশার মানুষ, যাকে জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, কসাই বা বুচার। ডাক্তারকে তিনি বুচার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। আবেদ ভাই খুব সুন্দরভাবে হাসতে পারতেন। অতি ভদ্রলোক।‘
তিনি আরও বলেছিলেন, `আবেদ ভাই খাওয়াতে ভালোবাসতেন, আমি খেতে ভালোবাসি। আমরা এক হিসেবে দুই প্রান্তের মানুষ। কিন্তু একটা সময় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দু’জনকে খুব কাছে এনে দিল। আমরা এক সময় দু’জনই বিলাতে ছিলাম। কিন্তু সেখানের চেয়েও বড় পরিচয়টা হলো মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পরে আমাদের দু’জনের সাক্ষাৎ।‘
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আবেদ ভাইয়ের সবচাইতে বড় গুণ হলো তিনি সবকিছু খুব বড়ভাবে দেখেছেন।’ মাঝে মাঝে ফোন করে তিনি বলতেন, ‘জাফরুল্লাহ কী করেন?’ বলতাম, এই আছি। তিনি বলতেন, ‘চা খেতে আসেন।’ ওই যে বললাম, ‘তিনি খাওয়াতে ভালোবাসেন, গল্প করতে ভালোবাসেন।’ এক সময় আমি তাকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সমস্যা ও ডায়ালাইসিস সেন্টারের স্বল্পতার কথা বলি। সব শুনে জানতে চান, ‘কত টাকা লাগবে?’ আমার কাছে থেকে সব জেনে বললেন, ‘আমি ১০ কোটি দেব।’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন ব্র্যাকের অকৃত্রিম বন্ধু। সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট স্থাপনের কাজে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর অবদানের কথা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ সুলভে কিডনি প্রতিস্থাপন সেবা প্রদানের জন্য গড়ে তোলা কেন্দ্রটি ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ’-এর নামে নামকরণ করেছেন। মাত্র ৩ বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে আবেদ ভাই ও জাফর ভাই না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন!
মৃত্যুকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর সহধর্মিণী নারীনেত্রী শিরীন হক, কন্যা ও পুত্রসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, অনুরাগী এবং ভক্ত রেখে গেছেন।
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের রূপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সবই পেয়েছেন। দেশ ও জাতির জন্য তাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে সকলেই তাঁকে মনে রাখবে। তাঁর মৃত্যুতে ব্র্যাক পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা রইল।
ব্র্যাকের একজন কর্মী হিসেবে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি স্যার ফজলে হাসান আবেদ ভাই ও স্যার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি।
মহান আল্লাহ তাআলা উনাদের জান্নাত বাসী করুক।
আমিন।
It’s very good memories. Please keep it up.