জনসংখ্যা দিবস এবং জেন্ডার সমতার ডাক

July 13, 2023

জেন্ডার সমতার ভিত্তি হচ্ছে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে সম অধিকার নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি নারী সন্তান ধারণ করা বা না-করার মতো মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না।

গত ১১ই জুলাই পালিত হলো বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। জনসংখ্যা তো স্রেফ পরিসংখ্যান বা গাণিতিক সংখ্যা নয়, বরং আধুনিক সমাজে জনসংখ্যাকে ঘিরে অধিকার আর সমতার আলোচনা একটি প্রয়োজনীয় উন্নয়ন মাপকাঠি। এবারের জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য  ছিল “জেন্ডার সমতাই শক্তি : নারী ­­ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে হোক পৃথিবীর অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন।“ এই যে জেন্ডার সমতার শক্তিকে উন্মোচন করার কথা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ভীষণ রকমের আশাব্যঞ্জক। নারীর অধিকার নিশ্চিত করা মানে যে বিশ্বের অবারিত সম্ভাবনাগুলোকে উন্মুক্ত করা তা এবারের প্রতিপাদ্যে উঠে এসেছে জোড়ালোভাবে।

বিশ্বের জনসংখ্যা যখন ৫ বিলিয়ন পেরিয়েছিল, সেই ১৯৮৯ সাল, তখন থেকেই জাতিসংঘ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এই ২০২৩-এর এই উদ্‌যাপনে এসে আমরা জেন্ডার সমতার নিহিত শক্তির কথা বলছি, যা কি না পৃথিবীব্যাপী জেন্ডার অসমতার ভয়াবহতাকেই তুলে আনে।

এই বিশ্ব আজ ৮ বিলিয়িনের পরিবার, এই পরিবারের ৪৯.৭ ভাগ নারী, সংখ্যায় যা ৪ বিলিয়নের কাছাকাছি। বর্তমান বাস্তবতায় এই চার বিলিয়ন নারী- মানবতার অর্ধেক– অথচ শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী গর্ভাবস্থা বা প্রসবের কারণে মারা যায়, অথচ বিজ্ঞান বলছে প্রতিটি মাতৃমৃত্যুই প্রতিরোধযোগ্য।

জনসংখ্যা সংক্রান্ত সকল আলোচনায়, যেমন ধরুন জনসংখ্যা নীতি, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও গতি প্রকৃতি, এমনকি জনসংখ্যা বিদ্যার তিনটি মূল উপাদান- জন্ম, মৃত্যু, অভিবাসন এসবের কোনো আলোচনাতেই নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।

জনসংখ্যা সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনাই সংবেদনশীল। তবে নারীকে বাদ দিয়ে বা নারীকে উপেক্ষা করে জনসংখ্যা সম্পর্কিত আলোচনা বাহুল্য বৈ কিছু নয়। মনে রাখতে হবে, নারীর কণ্ঠ উন্মোচন করা মানে অসীম সম্ভাবনাগুলোকে তুলে আনা।

এখন থেকে ত্রিশ বছর আগে, ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ICPD)- এ আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, যেখানে মানুষেরা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবে, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে পারবে এবং পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অধিকার এবং স্বাচ্ছন্দ্য  উপভোগ করতে পারবে। এই স্বপ্ন হয়তো অনেক দেশ ও জাতি বাস্তবে পরিণত করতে পেরেছে। জনসংখ্যা আজ সর্বকালের সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছেছে, স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হয়েছে পৃথিবীব্যাপী, মানুষ দীর্ঘায়ু পেয়েছে, তবুও, অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ এই প্রতিশ্রুতির নাগালের বাইরে রয়ে গেছে এবং সেখানে বেশি সংখ্যায় রয়েছে নারী, যারা শুধুমাত্র জেন্ডার বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

জেন্ডার সমতার ভিত্তি হচ্ছে, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে সম অধিকার নিশ্চিত হওয়া। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি নারী সন্তান ধারণ করা বা না-করার মতো মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না।

অন্যদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো জেন্ডার বৈষম্য। সারা বিশ্বে যেখানে নারীরা বিভিন্ন মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত, যেমন: শিক্ষার অধিকার, বাড়ির বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা, নিজের শরীরের ওপর অধিকার ইত্যাদি, সেখানেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। শিক্ষা, কর্মশক্তি এবং নেতৃত্বে নারীর প্রান্তিকতা তার প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়।

জেন্ডার  সমতার বার্তাটি একটি শক্তিশালী বার্তা। আসুন আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হই, যেখানে আমাদের প্রত্যেকের উন্নতির সমান সুযোগ রয়েছে, যেখানে প্রতিটি জাতির প্রকৃত সম্পদ, তার ‘মানবসম্পদ’, তার আকার বা বিকাশের স্তর যাই হোক না কেন, সবাই সমান সুযোগ পাবে। নিশ্চিত করতে হবে সুযোগগুলো যেন অর্ধেক মানুষের জন্য আলাদাভাবে সাজানো না থাকে। জনসংখ্যা ও যৌন-প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নয়ন-বিষয়ক সকল নীতি ও পরিকল্পনায় নারী কী চায় তা জানতে চাওয়া ও তা বাস্তবসম্মতভাবে সন্নিবেশিত করা এবং সর্বোপরি নারী যেন তার মতামত প্রদানের স্থান ও পরিবেশ পায় তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।

টেকসই ও ন্যায্য বিশ্ব গড়ে তুলতে আমাদের অবশ্যই জেন্ডার সমতাকে এগিয়ে নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং সংঘাতসহ আমাদের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে এমন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নারীর সৃজনশীলতা, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত তার গঠনমূলক প্রজ্ঞা, দিনের পর দিন বৈরিতার সঙ্গে বসবাসের কারণে গড়ে ওঠা দৃঢ়তা, যাকে আমরা resilience  বলি, এসব মৌলিক সম্পদ এবং শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।

UNFPA 2023 স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট-এর ভাষ্যমতে, সমাজে মেয়েরা যখন নিজের জীবন ও দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়, তখন তারা ও তাদের পরিবার উন্নতি লাভ করে।

এখন সময় হয়েছে সারা বিশ্বের নারীর সমর্থনে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রতিরোধের গল্পগুলো সামনে নিয়ে আসা। মেয়েশিশুকে বিজ্ঞান পাঠের বাইরে রেখে, নারীকে দক্ষ কর্মশক্তি এবং নেতৃত্বের কাঠামোতে ঢুকতে না দিয়ে, তাদের স্বাস্থ্য এবং যৌন ও প্রজনন জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করে, নারীকে দমিয়ে রেখে এবং সহিংসতা, ক্ষতিকারক চিরায়ত অভ্যাস দিয়ে তাকে ঘরে আটকে রেখে কিংবা প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনায় ফেলে তাদের দুর্বলতা বৃদ্ধি করে কোনো জনসংখ্যা আলোচনাই উন্নয়নমুখী আলোচনা হতে পারে না।

সারা বিশ্বজুড়ে জেন্ডার সমতা এখন আর কোনো বিশেষ ক্যম্পেইন নয়, বরং একটি অঙ্গীকার। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (BDHS 2022)-এর নবম জাতীয় সমীক্ষা অনুযায়ী দেখে নিতে চাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান। এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছিলেন ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ৩০,০৭৮ জন নারী ।

  • ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে মাধ্যমিক বা উচ্চতর শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে (২০১১ সালে ছিল ১২%, ২০২২ সালে হয়েছে ২৪%)।
  • বাল্যবিয়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে এমন নারীদের অনুপাত হ্রাস পেয়েছে, ২০১১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৫% এবং ২০১৭-১৮ সালে তা ৫৯%-এ নেমে এসেছে।
  • ১৫-১৯ বছর বয়সী ২৩ শতাংশ নারী সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়ার ঢুকে পড়েছে অর্থাৎ, তাদের একটি সন্তান হয়েছে বা তারা গর্ভবতী)। ২০১৭-১৮ সালে কিশোরী মায়ের সংখ্যা কমেছে আগের চাইতে ৪ শতাংশ ।
  • ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের অর্ধেকেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সের আগেই। তাদের মধ্যে ২৭ শতাংশের অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজনের বিয়ে হয়েছে ১৬ বছর বয়সের আগে।
  • ২০-২৪ বছর বয়সী ৬০% বা তার বেশি নারী যারা মাধ্যমিক স্কুলে পড়া শেষ করেননি তাদের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সের আগে, আর যারা মাধ্যমিক বা উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন তাদের মধ্যে এই হার ৩২%। সুতরাং, বিবাহের বয়স বিলম্বিত হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রভাব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটে যখন নারীরা মাধ্যমিক শিক্ষা পূর্ণ করেন।
  • মোট উর্বরতার হার (TFR), অর্থাৎ নারী তার জীবদ্দশায় কতটি শিশু জন্ম দেয় এই হার ২.৩%। এই হার ২০১১ সাল থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে।
  • ৫৫% নারী গর্ভনিরোধের আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে। সামগ্রিকভাবে, নারীদের মধ্যে ১০% পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় চাহিদা (unmet need) রয়েছে।
  • ৭২% নারী যাদের দুটি জীবিত সন্তান রয়েছে তারা আর সন্তান চান না।
  • প্রতি ১০জনের মধ্যে ৭জন শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষিত চিকিৎসা প্রদানকারীদের উপস্থিতিতে। ২০১১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মেডিক্যাল প্রশিক্ষিত সেবা প্রদানকারীর উপস্থিতিতে জন্মহার বেড়ে ৩৩ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
4 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments