সারাদিনে ৫০টিরও বেশি ফোন ধরতে হয়েছে। প্রথমে সময় নির্ধারিত ছিল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। কিন্তু করোনাভাইরাসের আতঙ্কে অনেকের পক্ষেই নির্ধারিত সময়সীমা মেনে চলা সম্ভব হয়নি। অনেকের সঙ্গেই দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতে হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি মানসিক কাউন্সেলিংও করতে হয়েছে।
‘কেউ সকাল ছয়টায় ফোন দিয়ে তার ভীতির কথা বলছেন আবার কেউবা রাত দুটোয় ফোন দিয়ে কাঁদছেন। কারণ তিনি নাকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবুও হাসিমুখে দিনরাত সব কল রিসিভ করে গেছি, মানুষকে সাহস জুগিয়েছি, বুঝিয়ে বলেছি জ্বর-ঠান্ডা মানেই করোনা আক্রান্ত হওয়া নয়। সুতরাং আপনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন না।’ এভাবেই টেলিকাউন্সেলিং সেবা দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন ডা. মিঠুন গুপ্ত।
ব্র্যাককর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করতে টেলিকাউন্সেলিং সেবা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক। কর্মীদেরকে একটি হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর লক্ষণ বা উপসর্গ, চিকিৎসা ছাড়াও অন্য যে কোনো রোগের ক্ষেত্রে পরামর্শ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন ব্র্যাকের ১৯ জন চিকিৎসক। তারা পালাক্রমে সপ্তাহের ৭ দিন এবং দিনের ২৪ ঘণ্টাই সেবা দিয়ে চলেছেন। ডা. মিঠুন তাদেরই একজন।
ডা. মিঠুন যে টেলিকাউন্সেলিং সেবা দিচ্ছেন, তার জন্য কিন্তু তার অফিসের কাজ থেমে নেই। অফিসের সব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি এই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির সিনিয়র সেক্টর স্পেশালিস্ট হিসেবে তিনি কাজ করছেন। এখানে মাদার অ্যাট ওয়ার্ক নামক একটি প্রোজেক্ট পরিচালনা করছেন। মূলত এটি ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত একটি প্রোজেক্ট, যেখান থেকে কর্মজীবি মায়েদের মাতৃত্বের অধিকার ও সন্তানদের ব্রেস্টফিডিং নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। প্রধান কার্যালয় থেকে তিনি একাই এটি পরিচালনা করছেন। ৮২ টি কারখানায় সুনিপুণভাবে কাজ করতে যেখানে ১৫ জন কর্মী প্রয়োজন, সেখানে কর্মী আছে মাত্র ৯ জন। বর্তমান পরিস্থিতে নতুন নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব নয়। তাই ৯ জনকে নিয়েই কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
ডা. মিঠুন একইসঙ্গে মায়ের ভূমিকাও পালন করেন। ৫ বছর বয়সী মেয়েটির স্কুল বন্ধ থাকায় তার শিক্ষা যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করতে হচ্ছে। সময় পেলে নিজেই মেয়েকে পড়াচ্ছেন, যাতে সে পিছিয়ে না পড়ে। ঘরে একা থেকে মেয়েটি যেন বিষাদে না ভোগে, সেজন্যও তাকে সময় দেওয়া জরুরি।
ডা. মিঠুনের স্বামী উজ্জ্বল কুমার ঘোষও পেশায় চিকিৎক। তিনি ঢাকাস্থ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তাকে ফ্রন্টলাইনে কাজ করতে হচ্ছে। সব সময় রোগীদের মধ্যে থাকার কারণে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তো আছেই। কিন্তু একজন চিকিৎসকের পক্ষে এই মুহূর্তে ঘরে বসে থাকা কী সম্ভব? মানুষের এই বিপদের সময়ে তাদেরকে সেবা দেওয়ার জন্য তাকে কর্মস্থলে যেতেই হবে। তাই প্রতিদিন সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার সময়ে উদ্বেগ লুকিয়ে রেখে হাসিমুখেই তাকে বিদায় জানান মিঠুন। তারপর নিজেও ব্র্যাককর্মীদের স্বাস্থ্য সহায়তা দেওয়ার কাজে মন দেন।
বর্তমানে তার জন্য সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জ, তা হলো একজন চিকিৎসক, একজন উন্নয়নকর্মী ও একজন মা- এই তিনের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে নিজের দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করা। তিনটি দায়িত্বের কারণে ২৪ ঘণ্টা সময়কেও যেন কম বলে মনে হচ্ছে!
এই পরিস্থিতির জন্য তারা কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। ২৪শে মার্চ ২০২০ তারিখে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ৬ জন চিকিৎসক মিলে ফোনের মাধ্যমে কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করবেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল হালকা উপসর্গ বা লক্ষণ মনে করলেই কেউ যেন চিকিৎসকের কাছে ছুটে না যান। জ্বর বা কাশির মতো চিকিৎসা বাসাতে থেকেই করা সম্ভব। এ সময়ে বাইরে বের হলে বা সবাই হাসপাতালে ছুটে গেলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। বরং কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে সাহস জোগানোই ছিল এ কাজের লক্ষ্য।
সারাদিনে ৫০টিরও বেশি ফোন ধরতে হয়েছে। প্রথমে সময় নির্ধারিত ছিল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। কিন্তু করোনাভাইরাসের আতঙ্কে অনেকের পক্ষেই নির্ধারিত সময়সীমা মেনে চলা সম্ভব হয়নি। অনেকের সঙ্গেই দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতে হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি মানসিক কাউন্সেলিংও করতে হয়েছে। কোনো রোগী বেশি আতঙ্কিত হলে তার রোগ প্রতিরোধ করার শক্তিও কমে যায়। দীর্ঘ সময় লাগলেও ব্র্যাকের সকল চিকিৎসক টেলিকাউন্সিলররা চেষ্টা করেছেন কর্মীদের কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিকভাবে শক্তি যোগাতে। তবে, বর্তমানে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯ জন করায় রোস্টার করে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন এবং চাপও কিছুটা কমেছে।
‘কর্মব্যস্ততার জন্য স্বামী পারিবারিক কাজে খুব বেশি সময় দিতে পারেন না। তবুও তার কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছি। যতটুকু সময় সে বাসায় থাকে, ঘরের কাজে সহায়তা করে, মেয়েকে দেখাশোনা করে। আমি হয়তো কোনো মিটিংয়ে আছি, সেই সময়ে ওকে কল সেন্টারের ফোনটি বুঝিয়ে দিয়েছি। সে চিকিৎসক হওয়ায় আমার পরিবর্তে কর্মীদের ফোনকল রিসিভ করে স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছে। চাইলেই মিটিংয়ের সময়টুকু ফোন বন্ধ বা সাইলেন্ট করে রাখতে পারতাম। কিন্তু, চাইনি একজন কর্মীও সেবা না পেয়ে আশাহত হোক।’ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন ডা. মিঠুন।
স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। সে যখন হাসপাতাল থেকে ফিরছে, তখন নিজে আক্রান্ত হয়ে ফিরছে না তো? তার মাধ্যমে তার সন্তান আক্রান্ত হচ্ছে না তো? তিনি যখন বাসায় ফেরেন প্রথমেই তাকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। এরপর তিনি কিছুক্ষণ আলাদা ঘরে থাকেন। তবুও এক অজানা ভয় মনকে তাড়া করে। কিন্তু এ ভয়কে মনে জায়গা দিলে চলবে না। দুজনে যে যার মতো এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই যোদ্ধা দম্পতির মতো অসংখ্য ভালো মানুষ একযোগে কাজ করছে বলেই আমরা আশা পাই। ত্যাগের এ লড়াইয়ে ক্ষান্ত দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। সামাজিক কিংবা ব্যক্তিগত ত্যাগের মাধ্যমেই রচিত হচ্ছে অনেক অনুপ্রেরণার গল্প।
Great Contribution!
Go ahead, Apa. Excellent in your writing Capacity.
মেডিকেল টেকনোলজিষ্টদের নিয়ে ব্র্যাকের কাজের সাধুবাদ জানাই। অনেকদিনে নিয়োগ বন্ধ ছিলো এখন চালু করে আমাদের কাজের সুযোগ করে দেয়াতে অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। Go ahead brac.