গত বছর দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর কাজ বা চাকরি হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে থাকা অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে যাদের নতুন দরিদ্র বলে অভিহিত করা হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে ২০২০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে নতুন দরিদ্র ছিল মোট জনসংখ্যার ২১.২%। এ বছর (২০২১) মার্চ মাসে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৪.৮%। অর্থাৎ নতুন দরিদ্রদের বড়ো অংশ এখনও নিয়মিত বা স্থিতিশীলভাবে আয়মূলক কাজে যুক্ত হতে পারেননি। তাঁরা পরিবার নিয়ে কোনোমতে টিকে আছেন।
কোভিড-১৯ সংক্রমণের ফলে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি অর্থনীতি খাত এবং দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে অতিদরিদ্রের হার ছিল ১০.৫% (সূত্র: অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা)। বাংলাদেশ পরিসখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ২০.৫%। সরকার, বেসরকারি সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনেরা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি ঘটছে অত্যন্ত ধীর গতিতে।
দেশে করোনায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর হার উভয়ই সম্প্রতি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়াতে সরকারের পক্ষ থেকে দেশজুড়ে শাটডাউনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। এর ফলে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি আবারও একটি বড়ো ধাক্কার সম্মুখীন হতে পারে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে সাফল্য পেয়েছিল সেখানে দেশকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজটি আরও কঠিন হয়ে পড়তে পারে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। ২০২১-২০২২ সালের জাতীয় বাজেটে সরকার কোভিড-১৯ মোকাবিলার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ প্রণোদনামূলক কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়েছে যাতে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ মোট জিডিপির ৪.৩%। কিন্তু এর আওতায় গৃহীত উদ্যোগগুলোর বড়ো অংশই স্বল্পমেয়াদি সহায়তামূলক কার্যক্রম। এগুলোর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষ নগদ সহায়তা, শুকনো খাবার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ইত্যাদি পাচ্ছেন কিন্তু প্যাকেজটিতে দীর্ঘমেয়াদি যে সহায়তামূলক কার্যক্রম আছে সেগুলো মূলত ব্যাংক ঋণ নির্ভর এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য হওয়ায় এ থেকে কোভিড-১৯-এর কারণে আর্থিক দুরবস্থা ও খাদ্য সংকটে থাকা দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের উপকৃত হওয়ার তেমন সুযোগ নেই। তাই এই প্যাকেজের আওতায় দরিদ্র ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর বহুমুখী চাহিদা ও আর্থসামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগকে যুক্ত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি যতদিন পর্যন্ত না তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন, ততদিন পর্যন্ত তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে আর্থিক এবং খাদ্য সহায়তার কার্যক্রম রাখতে হবে।
গত বছর দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর কাজ বা চাকরি হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে থাকা অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে যাদের নতুন দরিদ্র বলে অভিহিত করা হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে ২০২০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে নতুন দরিদ্র ছিল মোট জনসংখ্যার ২১.২%। এ বছর (২০২১) মার্চ মাসে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৪.৮%। অর্থাৎ নতুন দরিদ্রদের বড়ো অংশ এখনও নিয়মিত বা স্থিতিশীলভাবে আয়মূলক কাজে যুক্ত হতে পারেননি। তাঁরা পরিবার নিয়ে কোনোমতে টিকে আছেন। গবেষণাটিতে আরও দেখা গেছে এঁদের মধ্যে কাজ পেয়েছেন এমন ব্যক্তিদের বড়ো অংশটি নিজের দক্ষতা অনুযায়ী কাজ না পেয়ে কম বেতনে স্বল্প দক্ষতা প্রয়োজন এমন কাজে যুক্ত হয়েছেন।
নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে মাননীয় অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ‘এটি সাময়িক। আমার মনে হয় না যে আমাদের কিছু করা দরকার। লকডাউনের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের এখন কাজ ফিরে পাওয়ার কথা। এতদিনে ক্ষুদ্র ব্যাবসাও খুলে যাওয়ার কথা।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ১৬ই জুন ২০২১)। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, সব নতুন দরিদ্র কাজ পাননি এবং শাটডাউন শুরু হলে কাজ হারিয়ে আরও মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের দরিদ্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এঁদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা দুটোই আছে, কিন্তু নিজে যে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন তা বাদে অন্য কী কাজ বা ব্যাবসা করা যায় সে বিষয়ে ধারণা নেই। তাই তাঁদের জন্য ব্যাবসা নির্বাচন, নতুন ব্যাবসাটির জন্য প্রশিক্ষণ, কিছু সময় পর্যন্ত ব্যাবসা পরিচালনায় নিয়মতি পরামর্শ প্রদান এবং ঋণদান – এই চারটি কাজ যদি করা যায় তাহলে তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে এই মানুষগুলো কোভিড-১৯-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন খাতে ব্যাবসা বা উদ্যোগ দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারবেন। এতে করে তাঁরা দীর্ঘমেয়াদে স্বাবলম্বী হবেন। পরবর্তীকালে আর কোনো সহায়তা লাগবে না তাঁদের।
সরকারের চলতি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমগুলো স্বল্পমেয়াদে সহায়ক হলেও টেকসইভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে সক্ষম নয়। এগুলোর আওতায় যে ভাতা প্রদান করা হয় তার পরিমাণ খুবই কম এবং সেগুলো কোভিড-১৯-এর মতো বড়ো ধাক্কা মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদা এবং দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী জনপ্রতি ভাতার পরিমাণ এমনভাবে বাড়ানো প্রয়োজন যাতে নিজেদের তাৎক্ষণিক জরুরি প্রয়োজন মিটিয়েও তাঁরা কিছু অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন বা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য যে ভাতা বা প্রশিক্ষণভিত্তিক কর্মসূচি রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক ক্ষমতায়ন ঘটাতে সহায়ক এমন কার্যক্রমকে যুক্ত করে সমন্বিত জীবিকায়ন কর্মসূচি পরিচালনা করা প্রয়োজন। সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো এ ধরনের বেশ কিছু কর্মসূচি আছে যেগুলো সর্বাঙ্গীন সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। ফলে নিজ প্রচেষ্টায় এই পরিবারগুলো দারিদ্র্যের শেকল ভেঙে টেকসইভাবে উন্নয়নের মূলস্রোতে যুক্ত হতে পারে। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো অংশীদারত্বের ভিত্তিতে এ ধরনের সমন্বিত জীবিকায়ন কর্মসূচি পরিচালনা করলে তা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না যদি দরিদ্র, অতিদরিদ্র এবং নতুন দরিদ্র – এই তিন শ্রেণির মানুষকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না যায়। গত বছর ও চলতি বছর (২০২০ ও ’২১) দুবছরেই সরকার পরিচালিত নগদ সহায়তা প্রদান কার্যক্রমে সঠিক উপকারভোগীদের চিহ্নিত না হওয়ার ঘটনা রয়েছে। উপকারভোগীর তালিকায় ভুল মানুষের অর্ন্তভুক্তিও ঘটেছে। তাই উপকারভোগী নির্বাচন করার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এর জন্য কার্যকর পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। এতে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তৃণমূলে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করে থাকে। এক্ষেত্রে সরকার তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে। বেসরকারি সংস্থার তৈরি করা তালিকা যাচাই-বাছাই করে সেখান থেকে উপকারভোগীদের সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে উপকারভোগী চিহ্নিত ও নির্বাচনের কাজটি সহজ হবে, সম্পদেরও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
কোভিড-১৯ সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে আয় হারানো অসংখ্য পরিবার কম খেয়ে, শিশু সন্তানদের কাজে পাঠিয়ে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না করে কোনোমতে টিকে আছে। তারা অপরের সহায়তা ও ঋণের উপর নির্ভরশীল। এতে তাদের যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে তার প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মও দারিদ্র্যের শেকলে বন্দি হয়ে পড়তে পারে। তাই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং দারিদ্র্য বিমোচনকে সমন্বিত মানব উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা জরুরি। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ব্যক্তিমালিকানা খাতকে নিবিড় পরিকল্পনা অনুসরণ করে সমন্বিতভাবে ও একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলেই সংকট কাটিয়ে বাংলাদেশ আবারও উন্নয়নের মূলধারায় ফিরে আসবে এবং সামনে এগিয়ে যাবে।
সম্পাদনায় তাজনীন সুলতানা এবং প্রিসিলা রাজ