“সৃষ্টিকর্তাই আমাদের বাঁচাবে, কোনো আলাদা থাকার দরকার নাই, হাত কেন ধুতে হবে”- এই কথাগুলো বস্তির প্রায় সবার কাছ থেকে শুনেছি আমি। শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বললে কেউ আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইতেন না। এটাই ছিল মানুষকে সচেতন করার পথে প্রথম ধাক্কা। অজ্ঞতা যে দুর্যোগ প্রতিরোধের পথে কত বড় প্রতিবন্ধকতা তা এই মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি।
বছর চারেক হলো আমি ব্র্যাকে স্বাস্থ্যসেবিকা হিসেবে আছি। আমার কর্মস্থল ঢাকার জামালকোট এলাকায়। সেখানকার বস্তিবাসী, বিশেষ করে মায়েদের আমি চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি।
প্রায় ৩,৫০০ পরিবার বাস করে এই বস্তি এলাকায়। তাদের অনেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিনগুলোতে নানা আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ দুর্যোগের সময় সেসব এলাকাতেই গুজব এবং ভুল ধারণা বেশি থাকে, যেখানে সচেতনতার আলো পৌঁছায়নি। যারা গর্ভবতী, তাদের ভয় অন্যদের থেকে বেশি। এই রোগ বিষয়ে সচেতনতার লেশমাত্র তাদের ছিল না।
“সৃষ্টিকর্তাই আমাদের বাঁচাবে, কোনো আলাদা থাকার দরকার নাই, হাত কেন ধুতে হবে”- এই কথাগুলো বস্তির প্রায় সবার কাছ থেকে শুনেছি আমি। শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বললে কেউ আমার কথা বিশ্বাসই করতে চাইতেন না। এটাই ছিল মানুষকে সচেতন করার পথে প্রথম বাধা। অজ্ঞতা যে মানুষের কত বড়ো শত্রু তা এই মানুষগুলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি।
কিন্তু আমি থামিনি। থেমে গেলে এই মানুষগুলোর কী হবে? আমরা ১০ জন স্বাস্থ্যসেবিকা বস্তির প্রতিটি পরিবারের ঘরে গিয়েছি। আমাদের অন্যান্য নিয়মিত কাজের পাশাপাশি তাদের সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন এবং পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে প্রতিনিয়ত সচেতন করার চেষ্টা করে আসছি।
আমি ও আমার অন্য সহকর্মীদের রোজই প্রায় ৮-১০ জন গর্ভবতী নারী ফোন করেন। একটু একটু করে তারা এই রোগ সম্পর্কে যত জানছেন, তত তাদের মধ্যে সচেতন হওয়ার চেষ্টা কিছুটা হলেও বাড়ছে।
সাথী নামের একজন ১৭ বছরের নারী বাস করেন এখানে, যার আছে ৮ মাস বয়সি মেয়ে। কিছুদিন আগে তার জ্বর আসে, সে সঙ্গেসঙ্গেই আমাকে জানায়। ব্যাকুল কণ্ঠে বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকে, তার শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা তাকে এখন আলাদা করে রাখবে কি না, প্রতিবেশীরা কী বলবে, তার মেয়ের কী হবে ইত্যাদি।
আমি তাকে প্রথমে শান্ত হতে বলি। করোনার লক্ষণের সাথে তার কী কী লক্ষণ মেলে তা জানতে চাই। তাকে বোঝাতে সক্ষম হই যে, নিজেকে কিছুটা আলাদা রাখাটাই এখন নিরাপদ।
বস্তি এলাকার স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর জন্য ঘরে থাকা মানে উপার্জন বন্ধ। তাদের এই চরম দুঃসময়ে একই সাথে সচেতনতা এবং আর্থিক সহায়তা খুবই প্রয়োজন। সচেতনতা তৈরির জন্য প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে যদি আমাকে কাজ করতে বলা হয়, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিছু প্রাণ তো বাঁচবে।
আমার পরিবারের সবাই, বিশেষ করে আমার স্বামী আমাকে নিয়ে খুবই টেনশন করেন। প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞাসা করে কেন এত ঝুঁকি নিয়ে আমি কাজ করছি। আমি বলি, আজ আমার কারণে তো অনেক মানুষই এই রোগ কতটা ভয়াবহ তা জানতে পেরেছে। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করি, আমাকে নিয়ে তোমার গর্ব হয় নিশ্চয়ই? মুখে কিছু না বললেও তার মুখ দেখে আমি ঠিকই বুঝি, আমাকে নিয়ে সে একটু হলেও গর্ব করে, কিন্তু বলতে ভয় পায়, পাছে আরও ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সেবা দিতে শুরু করি!
অনুলিখন- সুহৃদ স্বাগত
সম্পাদনা- তাজনিন সুলতানা
That’s fantastic.
Proud of you