মারমা সম্প্রদায়ের লোককাহিনিটি আমাদের নিমিষে নিয়ে যাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্ত-সবুজ পাহাড়ের কোনো একটি ছোটো গাঁয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত এথনিক জনগোষ্ঠীর খুব কাছে।
আফ্রু কী এমে কীরো প্রেমা (সাদাটিয়া কালোটিয়াদের দেশে)
পাইবোং থাকে পাহাড়ি গ্রামে। একদিন বাড়ির উঠোনে তিল রোদে দিয়ে তার মা-বাবা জুমচাষ করতে গেলেন। যাওয়ার আগে পাইবোংকে বলে গেলেন, শস্য যেন পাখি না খায় তা দেখে রেখো। মা-বাবা চলে যেতেই এক ঝাঁক সাদাটিয়া, কালোটিয়া পাখি উঠোনে নেমে এল। টিয়াপাখিরা দয়ালু পাইবোংকে বুঝিয়ে রাজি করাল এবং শস্যদানা খেয়ে গেল। যাওয়ার আগে পাইবোংকে অভয় দিয়ে বলল, ‘মা বকুনি দিলে আমরা তো আছি, চলে যেও আমাদের দেশে। মন ভালো হয়ে যাবে।’ ওদিকে দিন শেষে বাড়ি ফিরে উঠোনে তিল দেখতে না পেয়ে মা-বাবা গেলেন রেগে। পাইবোংকে দিলেন বকুনি। মনের দুঃখে পাইবোং টিয়াদের দেশেই চলে যাবে বলে ঠিক করল।
পাইবোং পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেল সাদাটিয়া, কালোটিয়াদের দেশে। তারা তো পাইবোং দিদিকে দেখে ভীষণ খুশি। তারা দিদির সেবা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিয়ারা দিদিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সোনার সিঁড়ি দিয়ে বাড়িতে উঠবে, না কি বাঁশের সিঁড়ি?’ পাইবোং সরল মনে বলল, ‘সোনার সিঁড়ি বেয়ে কখনও উঠিনি। বাঁশের সিঁড়িই দাও।’ দিদির সরলতায় খুশি হয়ে টিয়া পাখিরা সোনার সিঁড়ি দিয়েই তাকে বাড়িতে নিয়ে গেল। সাদাসিদে ভালো মানুষ দিদিকে তারা অনেক যতœ করল, উপহার দিল দামি দামি মণিমুক্তা, সোনাদানা। তাদের আতিথেয়তায় পাইবোংয়ের মন ভালো হয়ে গেল।
শিশুদের মনোজগতে গল্পের প্রভাব
শিশুদের কল্পনার জগতে যে গল্পগুলো প্রভাব ফেলে তা তাদের জ্ঞান অর্জনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। রূপকথার গল্পগুলো শিশুদের কল্পনার জগতকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে। শিক্ষা পাঠক্রমে লোককাহিনি যুক্ত করা হলে তা শিশুদের মনের দুয়ার খুলে দেয়, মানবিক গুণাবলির বিকাশে সহায়তা করে।
এক নজরে ব্র্যাকের এথনিক স্কুল
এথনিক শিশুদের নিকট শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে ব্র্যাক এডুকেশন ফর এথিনক চিলড্রেন (ইইসি) শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। ইইসি স্কুলে মূলধারার পাঠক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গল্প পড়ানো হয়। এ ধরনের স্কুলে দুইজন শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। একজন বাংলাভাষায় পাঠদান করেন, অপরজন সংশ্লিষ্ট এথনিক সম্প্রদায়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে থাকেন। সহকারী শিক্ষিকা প্রথমে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় গল্পটি পড়ে শোনান। তারপর অপরজন আবার বাংলায় পাঠদান করেন। গল্পগুলো পড়ে শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কেই ধারণা পায় না, এতে করে তাদের শব্দভান্ডারও বৃদ্ধি পায়।
ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম (বিইপি) এথনিক শিশুদের জন্য ২০০৮ সালে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা (এমটিবি-এমএলই) কার্যক্রম শুরু করে। এমএলই স্কুলে শিক্ষার্থীদের তাদের নিজস্ব বর্ণমালা ও ভাষায় পাঠদান করা হয়। ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রমের এমএলই চাকমা প্রকল্পের জন্য প্রি-প্রাইমারি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মারমার প্রকল্পের জন্য প্রি-প্রাইমারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই ও সহায়ক পাঠ্য উপকরণ উন্নয়ন করা হয়েছে। বিইপির কর্মীগণ গল্পের বই উন্নয়ন এবং বিভিন্ন এথনিক সম্প্রদায়ের লোককাহিনী সংগ্রহ করে থাকেন।
নিজ ভাষার সঙ্গে জাতীয় ভাষার সেতুবন্ধ
গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, বিদ্যাশিক্ষার প্রথম বছরগুলোতে শিশুরা যদি তাদের মাতৃভাষায় শেখে তাহলে তারা খুব দ্রুত শিখতে পারে। যেসব শিশুদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রথম ভাষা মাতৃভাষা নয়, তাদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া বা পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
শিশুরা যখন মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে তখন তারা সহজে বুঝতে ও আয়ত্ত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব এথনিক শিশু সরাসরি জাতীয় ভাষায় (বাংলা, যা তাদের মাতৃভাষা নয়) শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের তুলনায় যেসব এথনিক শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পায় তারা তুলনামূলক ভালোভাবে শিখতে পারে । এর ফলে শিক্ষার পরবর্তী ধাপে প্রচলিতধারার স্কুলের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না।
আলোর পথে যাত্রা
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDG)-র অন্যতম অঙ্গীকার হচ্ছে ‘Leaving no one behind’। যাদের প্রয়োজন সবচাইতে বেশি তাদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ব্র্যাক নানা কর্মকা- পরিচালনা করছে। এথনিক স্কুল হলো এমনই একটি উদ্যোগ। ব্র্যাকের এথনিক স্কুলে বর্তমানে ২৭হাজারের বেশি এথনিক শিশু লেখাপড়া করছে। এ পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েশন করে বের হয়েছে ২ লক্ষেরও বেশি শিশু।
শিশুদের একুশ শতকের উপযোগী করে গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। সুতরাং লেখাপড়া শেখার মাধ্যমে সকল শিশু নিজেদের সম্ভাবনা বিকাশের সুযোগ পাবেÑএ প্রত্যাশা হোক সকলের।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: লিমিয়া দেওয়ান, ডিপ্লোমা বনোয়ারি এবং স্বপন চাকমা, শিক্ষা কর্মসূচি