মনের ঘরে তালা

October 14, 2018

২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ৫-১৮ বছর বয়সিদের ওপর মানসিক স্বাস্থ্যের একটি জরিপ হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় ১৮.৪ শতাংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরী কোনো-না-কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। তবে আশার কথা এই যে, মানসিক চাপমুক্তি ঘটিয়ে বিষণ্ণতা আক্রান্ত সন্তানের সহায়তায় মা-বাবাই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন।

আজ রবিবার। না আমি টিভিতে দেখা জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয় নাটক আজ রবিবার অথবা ‘ধরা যাক আজ রোববার কোনো কাজ নেই…’-কবীর সুমনের শ্রুতিমধুর গানের কথা বলছি না। আমি বলছি সাপ্তাহিক ছুটি শেষে প্রথম অফিস দিনটির কথা। অফিস শেষে বাড়ি ফিরেই মেয়ের মুখোমুখি। আশা, হতাশা, জিজ্ঞাসা- সবই তার মুখে খেলা করছে। জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়োগা ম্যাট কিনে আননি মা?’ ও আচ্ছা, এই ব্যাপার!

মেয়েকে আমি গত সপ্তাহেই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইয়োগা অ্যান্ড মেডিটেশন সেশনে ভর্তি করে দিয়েছি। তাই সে দারুণ এক্সসাইটেড! নতুন কিছু শেখার নেশায় সে বুঁদ হয়ে আছে-এটাই তো কিশোর বয়সের ধর্ম। ঘরে ও ঘরের বাইরে নতুন বন্ধু, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, নতুন কিছু করা, নতুন দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া-এরকম কত নতুন এসে জমা হয় তাদের জীবনে। কখনও কখনও এই পরিবর্তনকে তারা খুশি মনে মেনে নেয় আবার কখনও এসবই তার মনে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। তার মনকে প্রভাবিত করে। সে একধরনের চাপ অনুভব করে। তাদের মনে দুঃখ দুঃখ ভাব, একাকিত্ব দখল করে নেয় মন। হঠাৎ শিস দিয়ে গান গেয়ে ওঠা চঞ্চল ছেলে বা মেয়েটির মনের ঘরে পড়ে তালা। সে চুপচাপ সময় কাটায়। তাকে বুঝে ওঠা তখন দায়।

এই যে আমার মেয়ে আজ এত খুশি কিন্তু প্রথম যেদিন ইয়োগা সেশনের কথা শুনেছে সেদিন সে খানিকটা বিরক্তই ছিল। কেন মা তাকে নতুন কিছু শেখাতে চাইছে? তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে একদিন ক্লাস করালাম। ব্যস, তার মুড বদলে গেল। তার ভালো লেগেছে। এখন সে শিখতে চায়, আমাকেও শেখাতে চায়। তার ছোটো ভাইটিকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ শেখানোর জন্য সে নিজেই হয়ে যায় গুরুগম্ভীর শিক্ষক।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আসলে আমরা বিশেষ ভাবি না। ২০০৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ৫-১৮ বছর বয়সিদের ওপর মানসিক স্বাস্থ্যের একটি জরিপ হয়েছিল। সেখানে দেখা যায় ১৮.৪ শতাংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরী কোনো-না-কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। তবে আশার কথা এই যে, মানসিক চাপমুক্তি ঘটিয়ে বিষণ্ণতা আক্রান্ত সন্তানের সহায়তায় মা-বাবাই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন।

আপনার সন্তানের শরীরের পাশাপাশি তার মনেরও যত্ন নিন। তার পরিচিত পরিবেশকে নতুন করে সাজিয়ে তুলুন। নতুবা নতুন পরিবেশে তাকে জুড়ে নিন। দেখবেন, নতুন ভাবনা নতুন চিন্তা তাকে কর্মঠ করে তুলছে। তার কথা শুনুন। সে কী চায়, কীভাবে করতে চায় তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করুন। মূল কথা সখ্য গড়ে তুলুন সন্তানের সঙ্গে। ভুল থেকে শেখা, নতুন ধারণাকে গ্রহণ করা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন। সন্তানের সঙ্গে আপনি যখন কথা বলবেন তখন তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন। তাদের বলতে দিন। তাদের চোখে বিশ্বকে দেখুন।

শুধু সন্তানের কথাই বলছি কেন? আমরা বড়োরাই কি এর বাইরে। একটু ভেবে দেখুন তো আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে তাল মেলাতে না পারলেই মন কী ভীষণ কষ্ট পায়! জীবনটা হঠাৎ যুদ্ধ যুদ্ধ মনে হয়। তখন আমরা কীভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসি? হয়তো এমন কাউকে খুঁজি যার ওপর আস্থা রাখা যায়, মনের কথা খুলে বলা যায়। হতে পারে সে বন্ধু, আত্মীয় কিংবা সহকর্মী। সেই মুহূর্তে তার দেওয়া ভরসা বা আপনার প্রতি মনোযোগ যেন চিত্রটিকেই পাল্টে দেয়। মন খুশি হয়ে যায়, আবার কখনও ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবতে শেখায়।

মনের কোনো সীমানা দেয়াল নেই। মন যে কেবল পরিবার আর আত্মীয়, বন্ধুদের আবর্তেই থাকবে তা তো হয় না। এই লেখাটি লিখতে লিখতেই আমার মনে যে ছবিটি ভেসে উঠল তা হলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসরত মানুষের মুখ। মনে হলো, নির্যাতন, নিপীড়নের আর ধ্বংসযজ্ঞ থেকে এই অসহায় মানুষগুলো হয়তো পালিয়ে আসতে পেরেছে কিন্তু সেসময়ের ভয় আর আতঙ্ক হয়তো এখনও তাদের তাড়া করে ফেরে। সব হারানো এই মানুষগুলো কী ভীষণ মানসিক পীড়ার মধ্যে আছে। বড়োরা তো নানাভাবে সামলে ওঠার চেষ্টা করছে কিন্তু শিশু-কিশোররা তাদের মনের সেই ভয়াবহ চিত্র কীভাবে মুছবে? আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, এর মধ্যে শিশু সুরক্ষার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর-কিশোরীরা যাতে মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য প্যারামেডিক কাউন্সেলররা তাদের নিয়ে নিয়মিত সেশন পরিচালনা করছে। তাদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। ঘরোয়াভাবে আয়োজিত এই বৈঠকগুলো প্রধানত কিশোরীদের নিয়েই হয়। প্রত্যেকে মনের লুকানো কষ্টগুলোর কথা বলে। মনের টানাপোড়েন আর বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে আবার জীবন গড়ার কথা শোনে। প্যারামেডিক কাউন্সেলরসহ অন্য সবাই তার কথা মন দিয়ে শোনেন। এভাবেই সবাই সবাইকে সঙ্গী করে নেয়- আস্থা, ভরসা ও নির্ভরশীলতায়।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments