বৈশ্বিক অভিযোজন কমিশনের ঢাকা সম্মেলনে ডাঃ মুহাম্মাদ মুসা

August 5, 2019

জাতিসংঘের অষ্টম সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুনের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের ১৬ই অক্টোবর বৈশ্বিক অভিযোজন কমিশন (Global Adaptation Commission) যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে এই কমিশনের দুদিন ব্যাপী সভা গত ১০ই জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।

কমিশনের ১৭টি সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ঢাকা সভায় বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে যা এই বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে তুলে ধরা হবে। ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ডাঃ মুহাম্মাদ মুসা এই কমিশনের একজন নির্বাচিত কমিশনার। স্বাগত বক্তব্যে তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার ১১টি দেশে জলবায়ু পবিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ব্র্যাকের কাজ করার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি তুলে ধরেন। নিচে তাঁর বক্তৃতাটির অনুবাদ দেওয়া হলো।

বাংলাদেশের একজন উন্নয়ন কর্মী এবং গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপ্টেশনের একজন কমিশনার হিসেবে আজ আপনাদের স্বাগত জানাতে পেরে আমি গর্বিত। এই ভেবে আমি আরো সম্মানিত বোধ করছি যে, এই সভা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই আলোচনার জন্য বাংলাদেশের চাইতে উপযুক্ত কোনো স্থান আছে বলে আমার মনে হয় না। কেন? তার কারণগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি আমাদের বাংলাদেশ। এর ফলে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও ভয়াবহতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস পেয়েছে এবং রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) এই বলে সতর্ক করেছে যে, ভবিষ্যতে সাগরপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে প্রায় পাঁচ কোটি (৫০ মিলিয়ন) মানুষ গৃহহারা হবে।

একইসঙ্গে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উপযুক্ত নীতিমালা ও কার্যক্রম নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সবচেয়ে সক্রিয় দেশগুলোর একটি। এক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অনেকগুলো নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বে যত আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে তার সব কার্যকর প্রতিফলন ঘটেছে এসব নীতিমালায়।

বাংলাদেশই প্রথম দেশ যা নিজেদের অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নানা ধরনের স্থানীয় কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে যা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আমরা সকলেই জানি, পরিবেশসম্মত সমাধান থেকেই সার্বিক লাভ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিশেষ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষমতা জোরদার করার লক্ষ্যে ব্র্যাকসহ শত শত বেসরকারি সংস্থা স্থানীয় পর্যায়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জলবায়ুসহিষ্ণু টেকসই সব সমাধান উদ্ভাবনে কাজ করছে কয়েক ডজন গবেষণা সংস্থা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট, দ্য বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ।

জলবায়ু পরিবর্তনসহিষ্ণু সমাধানগুলোর বৃহত্তর প্রসারের কাজে ব্র্যাকের অবস্থান সামনের সারিতে। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় তৃণমূলের মানুষ এবং স্থানীয় অংশীদার সংস্থাগুলো। ব্র্যাক এক্ষেত্রে অনেকগুলো সমাধান প্রসারে কাজ করে চলেছে যার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে। এগুলো হচ্ছে, লবণসহিষ্ণু ফসলের জাত, উচ্চ ফলনশীল ফসল, খামার পর্যায়ে আগাম সতর্কবার্তা প্রেরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে জীবিকা নির্বাচন। এসব সমাধান ও কৌশল ঝুঁকির মুখে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা সহজতর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০১৬-২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৪১টি জেলার ৩,৩৫,৯৯০টি খানায় আমরা এসব সেবা পৌঁছে দিয়েছি। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিচালিত সকল কার্যক্রমে জলবায়ুসহিষ্ণু সমাধানের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে ব্র্যাক।

শহরাঞ্চলে জলবায়ুসহিষ্ণু সমাধান প্রসারে কাজ করার লক্ষ্যে এ বছর আমরা কেএফডব্লিউ (জার্মানির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উন্নয়ন ব্যাংক)-এর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল গঠন করেছি। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আইপিসিসি’র অভিযোজন বিষয়ক প্রতিবেদনের অন্যতম রচয়িতা ড. সালিমুল হক আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

আমরা এখন আমাদের সফল বড় মাত্রার জলবায়ুসহিষ্ণু কার্যক্রমগুলোকে বাংলাদেশের বাইরে এশিয়া ও আফ্রিকার যে ১০টি দেশে আমরা কাজ করছি সেখানে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। গুলোতে আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে সেই ১০টি দেশে আমাদের অভিযোজন কার্যক্রমের বিস্তারের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ব্র্যাকের এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আমাদের সঙ্গে আছেন অভিযোজন প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ড. সালিমুল হক।

জলবায়ুসহিষ্ণু সমাধানগুলোর বৃহত্তর প্রসারের জন্য ব্র্যাকের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনটি বিষয় আপনাদের বিবেচনার জন্য পেশ করতে চাই।

প্রথমত, তৃণমূল পর্যায়ে কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমগুলোর প্রসার ঘটানো জরুরি। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষের জন্য কোনো সমাধান বাস্তবায়ন করার চেয়ে মানুষকে নিয়ে কোনো সমাধান উদ্ভাবন করা হলে তা অনেক বেশি কার্যকর হয়। একই সঙ্গে নতুন নতুন প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশকে তৃণমূল পর্যায়ে অভিযোজন করার উদ্যোগ গ্রহণও জরুরি। এজন্য তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে আস্থাপূর্ণ সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এ জায়াগটিতেই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ভূমিকা এসে পড়ে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এইসব সংস্থাগুলোকে সহায়তা প্রদানের পথটি প্রায়শ বড়ই জটিল ও লম্বা। এ সমস্যার সমাধানে বিশ্ববাসীর এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত, যে দেশগুলো সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবার শঙ্কায় আছে সেখানে কমবয়সীদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং জলবায়ুসংক্রান্ত আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে প্রান্তিক অবস্থানের নারী ও শিশুর প্রতিও বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত এবং পদ্ধতিগত কার্যক্রমের মাধ্যমে এইসব জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে।

তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় অর্থায়ন ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। বস্তুত, সরকার, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও ব্যক্তিমালিকানা খাত – এই তিন পক্ষের যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমেই কেবলমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা সম্ভব এবং এই প্রয়াস সব পক্ষকেই লাভবান করবে।

সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এই বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমরা যারা কাজ করছি তাদের সকলের জন্য বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত মূল্যবান ও শিক্ষণীয়। আমি আশা করি সম্মেলনের আগামী দুদিন আমরা বাংলাদেশের শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতাগুলোর ওপর প্রচুর আলোচনা করার সুযোগ পাব। অভিযোজন বিষয়ে কার্যকর বৈশ্বিক আলোচনার জন্য বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন জরুরি।

 

অনুবাদঃ প্রিসিলা রাজ

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments