ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এ ঘটনা বন্ধও হতে পারে।
বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোতে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নারী ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি এখন আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে নিম্নবিত্ত – কোনো অবস্থানে কোথাও নিরাপদে নেই নারী ও শিশু। হোক সে রেলের অভ্যন্তরে বা রেলস্টেশন, বাসের অভ্যন্তরে বা বাস স্টেশন, রাজপথে অথবা গলিপথে, গ্রামে অথবা শহরে, নির্মানাধীন ভবনে, সুরম্য অট্টালিকা অথবা জরাজীর্ণ বস্তিতে, বিদ্যালয়ে অথবা নিজের বাড়িতে। দেশে নারী ও শিশু অধিকার সুরক্ষায় কঠোর আইন রয়েছে। এরপরও প্রতিনিয়তই দেশের কোথাও না কোথাও নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সংবাদপত্রের পাতায় অথবা স্যোশাল মিডিয়াতে নারী ও শিশুকে পাশবিক নির্যাতন (ধর্ষণ), হত্যা, গুম, অপহরণের খবর প্রতিনিয়ত থাকছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ৮টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদের ওপর ভিত্তি করে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে, তা এককথায় ভয়ঙ্কর।
বাংলাদেশ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমায় মোট ১১১৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৭ জনকে এবং আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন নারী ও শিশু।
অথচ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের নয় মাসে গত বছরের চাইতে ৩৮৩জন নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটেছে। দেখে নেওয়া যাক গত ৪ বছরে ধর্ষণ ও হত্যার পরিসংখ্যান:
২০১৮ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার ছিল ৭৩২ জন এবং ৭০ জন নারী ও শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে।
২০১৭ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার ছিল ৮১৮ জন এবং ৫৮ জন নারী ও শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে।
২০১৬ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার ছিল ৭২৪ জন এবং ৫৩ জন নারী ও শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে।
২০১৫ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার ছিল ৮৪৬ জন এবং ৬০ জন নারী ও শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে।
আরও জানতে ক্লিক করুন
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যতসংখ্যক নারী ও শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা আমরা পাই, ততটা বিচারের খবর আমরা পাই না। ধর্ষণ তথা যৌন নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে রাষ্ট্র। যদি ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে এ ঘটনা বন্ধও হতে পারে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য চাই সামাজিক জাগরণ। নারী ও শিশু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে, পুরুষ ও কিশোরদের মানসিকতার পরিবর্তনের পাশাপাশি ইতিবাচক জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে যেভাবে নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এগুলো রোধ করতে না পারলে আগামীতে সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাই নারী ও শিশু ধর্ষণ হত্যা নির্যাতন, অপহরণ এগুলো সমাজ বা রাষ্ট্রবিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এসব ঘটনা নিয়ে ভাবতে হবে এবং একই সঙ্গে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টাস্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হবে।
সমাজের নীতি-নৈতিকতাহীন কর্মকান্ড ও নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা অধিকাংশ সময় প্রভাবশালী অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় নিরাপদে থাকে। সেজন্য তাদেরকে আইনের আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব ঘটনা অবশ্যই সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র। এখনই এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের দৃষ্টাস্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের প্রত্যেককে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। নিজে সচেতন থাকতে হবে এবং নারীর প্রতি ছোটো-বড়ো সব ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। অন্যের ঘটনা মনে করে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে কথা বলতে হবে-প্রশাসনকে জানাতে হবে।