“চর ও হাওড় অঞ্চলের ৭টি শাখায় ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে মোবাইলভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির কার্যক্রম। এতে সদস্যদের জন্য ঋণের টাকা লেনদেন করা আগের চাইতে সহজ হয়েছে।”
‘আগে মহাজন ছিল, তাই নিজের হাতে সামগ্রী বিক্রি করতে পারতাম না। এখন নিজের হাতে বিক্রি করতে পারি’-এভাবেই অঞ্জলি বলছিলেন তার দিন বদলের গল্প।
আমরা কয়েকজন শিক্ষানবিশ হিসেবে ব্র্যাকে যোগ দিয়েছি। গত ১৯শে জুন ব্র্যাকের কর্মসূচি দেখতে আমরা গিয়েছিলাম ঢাকার ধামরাই উপজেলায়। সেখানেই শুনেছি জীবনসংগ্রামে জয়ী কয়েকজন নারীর কথা।
সেদিন একটি গ্রাম সংগঠনের সভায় গিয়েছিলাম। গ্রাম সংগঠন হলো দরিদ্র নারীদের একত্রিত হবার একটি প্ল্যাটফর্ম। এলাকাভিত্তিক খানা জরিপের মাধ্যমে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২৫ জন সদস্য নিয়ে গড়ে তোলা হয় গ্রাম সংগঠন। গ্রাম সংগঠনের সদস্যরা নিয়মিত সভা করে। সভায় সদস্যরা ঋণ ও সঞ্চয় নিয়ে কথা বলে, নিজেদের সুখ-দুঃখের কথাও বলে, আবার এই সভাতেই ব্র্যাককর্মীরা সদস্যদের আর্থিক বিষয়ে সচেতন করে তোলেন।
গ্রাম সংগঠনের সদস্য অঞ্জলি দিদির সঙ্গে কথা বললাম। তিনি পেশায় একজন মৃৎশিল্পী। মাটির পুতুল, খেলনা, হাড়িপাতিল, ফুলদানি ইত্যাদি তৈরি করেন। তার বয়স ৪৫ বছর। কথায় কথায় উঠে আসে অঞ্জলি দিদির জীবন সংগ্রামের গল্প। সংসারের টানাপোড়েন ঘোচানোর জন্য অনেককাল আগে তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই পেশা। প্রথম দিকে কাঁচামাল কেনার জন্য পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ ধারদেনা করতে হতো। এজন্য তাকে গুনতে হতো চড়া সুদ। মহাজনের অধীনে ফরমায়েশি কাজ করার অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে। তিনি বললেন, ‘মহাজন অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তি করে নেন। চুক্তি অনুযায়ী তৈরি সামগ্রী মহাজনের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য থাকে কারিগর। মহাজন কম দামে পণ্য কিনে নেয়, এরপর বেশি দামে বিক্রি করেন। এভাবে কাজ করলে খাটুনির তুলনায় পারিশ্রমিক পাওয়া যায় কম।’
ব্র্যাকের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হলো?-এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, পরিচিত মানুষদের কাছ থেকেই ব্র্যাকের গ্রাম সংগঠনের কথা শোনেন। ব্র্যাক দরিদ্র নারীদের টাকা ধার দেয় এবং সপ্তাহে সপ্তাহে ধারের টাকা অল্প অল্প করে পরিশোধের সুযোগ আছে। কাজেই ব্র্যাকের গ্রাম সংগঠনের সদস্য হলেন অঞ্জলি দিদি। ব্র্যাক থেকে দিদিকে ঋণ হিসেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হলো। পুরো টাকা তিনি ব্যবসায় খাটান। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। শ্রম ও সততা আজ তাকে নিয়ে এসেছে অনেক দূর। সংসারের অভাব ঘুচেছে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে জীবনে।
একজন ব্র্যাক কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি জানালেন, অঞ্জলি দিদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করেছিল। এজন্য পরে তাকে আরও এক লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এলাকার নারীদের কাছে অঞ্জলি এখন অনুপ্রেরণার উৎস।
ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের সহায়তা পাওয়া পরিবারগুলো নানারকম আয়বর্ধক কাজে অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। সদস্যদের আয়-ব্যয়ের উৎস, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতা ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করে ক্লায়েন্টদের ঋণ দেওয়া হয়। প্রতি মাসের তৃতীয় বুধবার সভানেত্রীর বাড়ির উঠোনে বসে গ্রাম সংগঠনের সভা। সভায় সদস্যরা নিজ নিজ পাশবই নিয়ে আসেন। সঞ্চয় ও কিস্তির টাকা সেখানেই জমা নেওয়া হয়।
ঋণ নিয়ে কেউ কেউ নিজেই কিছু করেন আবার কখনও স্বামীর ব্যবসায় লাগান। ঋণ নেওয়া ছাড়াও সদস্যরা স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ডিপিএস স্কিমে সঞ্চয় করতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের ৭০ লক্ষ ক্লায়েন্ট রয়েছে, যার শতকরা ৮৭ জনই নারী।
ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের আরেকজন সদস্য শিল্পী। তিনি বললেন, ব্র্যাক থেকে প্রথম ঋণ নেওয়ার পরপরই তিনি স্বামীকে হারান। শিল্পী ও তার স্বামীর নামে ঋণ নিরাপত্তা বিমা থাকায় তাকে টাকা পরিশোধ করতে হয়নি, বরং প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। ফলে সেসময় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ নিয়েও তাকে ভাবতে হয়নি।
কথা হয় কাপড় ব্যবসায়ী আয়েশার সঙ্গে। ব্যস্ত থাকার কারণে কখনও কখনও ডিপিএস স্কিমের টাকা সভায় এসে জমা দিতে পারেন না। একারণেই তিনি বেছে নিয়েছেন মোবাইল মানি প্ল্যাটফর্ম-বিকাশ। এর মাধ্যমে যথাসময়ে টাকা জমা দিতে পারছেন।
শুধু কি তাই! চর ও হাওড় এলাকার মানুষ যাতে মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির সেবাসমূহের আওতায় আসতে পারে সেজন্য ব্র্যাক চালু করেছে ক্যাশ লেস শাখার কার্যক্রম। চর ও হাওড় অঞ্চলের ৭টি শাখায় ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে মোবাইলভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির কার্যক্রম। এতে সদস্যদের জন্য ঋণের টাকা লেনদেন করা আগের চাইতে সহজ হয়েছে।
সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের কথা চিন্তা করে সাজানো হয়েছে ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন: চাকরিজীবীদের জন্য রয়েছে নির্ভরতা ঋণ, ক্লায়েন্টদের নিজ বা পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে চিকিৎসা ঋণ, কৃষকদের সুবিধার্থে রয়েছে কৃষিঋণ, মৌসুমি ঋণ ইত্যাদি।
দিন বদলের এই পালায় দরিদ্র মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন কিছু। আর এভাবেই প্রতিদিন হাজারও অঞ্জলি, আয়েশা আর শিল্পীর বদলে যাচ্ছে জীবন।
Outstanding..a clear view of your talent in your way of work and writing. Keep it up dear.