বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির একটি বড়ো অংশ বর্তমানে নারী শ্রমিক। সকালে ঘুম থেকেই জেগে আমরা দেখি হাজারও নারী শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে হেঁটে চলেছে। তাদের এই পথচলা যেন আমাদের অগ্রসরমান অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
পোড়ামাটির ইট আর লোহায় গড়া হাতুড়ির সংঘর্ষে অদ্ভুত এক সুর ও ছন্দের সৃষ্টি হচ্ছে। এ যেন কবিতার ছন্দ। জীবনের কথাগুলোকে গেঁথে নিচ্ছে একে একে। ইটগুলো প্রথমে আগুনে পুড়ে শক্ত হয়েছে, এবার আবার ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে, গড়ে তুলবে মজবুত ঢালাই। এভাবেই তৈরি হবে ইমারত, পূরণ হবে হয়তো কারও অনেকদিনের স্বপ্ন। ইট তাই হাতুড়ির কঠোরতার মধ্যেই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে। বালু আর সিমেন্টের বুকেই হয়তো তার শেষ আশ্রয়। তাই এক ধরনের সখ্যতা গড়ে উঠেছে এই ইট-পাথরের।
টুং শব্দ করে কী যেন পড়ে গেল। হঠাৎ থেমে যায় হাতুড়ির শব্দ। কাজের ব্যস্ততা ভুলে দুটো হাত খুঁজতে থাকে তার হারিয়ে যাওয়া পাঁচ টাকার কয়েন। মেয়ের কোমল হাত দুটো ইটের ফাঁক গলে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে গভীরে, আরও গভীরে। হারানো কয়েনটি ফিরে পাওয়ার আশায় তার সে কী প্রচেষ্টা! মেয়ের সঙ্গে মা-ও খুঁজে দেখেন। মায়ের কাছ থেকে মেয়েটি কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে কয়েনটি। তাই তা হারিয়ে যাওয়ায় সদ্য কিশোরীর মুখটা মেঘের মতো কালো। এই কয়েনটি দিয়েই সে দোকান থেকে হয়তো চিপস্ বা কোনো শখের জিনিস কিনত। কিন্তু তা আর হচ্ছে কই? মায়ের ইট ভাঙার কাজে সাহায্য করে তবেই সে কয়েনটি রোজগার করেছিল। এই অর্থে সে শিশু শ্রমিকও বটে। ছলছল চোখে পরিশ্রান্ত মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাক সে। মায়ের কপালের ঘাম আর মেয়েটির চোখের জল টপটপ করে পড়তে থাকে শুকনো ইটগুলোর ওপর। নিমিষে শুকিয়ে যায় সেই জলবন্যা। বড্ড গরম!
মা-মেয়ের কপালের ভাঁজ পরিণত হয় কষ্টের সীমারেখায়। বিষণ্ন মায়ের মুখ। মেয়েটি বড়ো হচ্ছে, চারিদিকের শকুনের কালো ছায়া। কীভাবে রক্ষা করবে মেয়েকে? কোলে রয়েছে আরও একটি শিশু। এখনও সে মায়ের কোলেই নিশ্চিন্তে ঘুমায়। জন্ম থেকেই তারা দেখছে কী নিদারুণ বাস্তবতা। মায়ের হাতুড়িটি যখন কর্কশ আওয়াজ তুলে পড়ে থাকা ইটগুলোকে ভাঙতে থাকে তখন ছোটো শিশুটি মায়ের কপালের ঘাম নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। মায়ের কোলই তো তার খেলার জগৎ।
ইতিহাসের পাতা থেকে দেখা যায় ১৮৮৬ সালে ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের একটি শ্রমিক সংগঠন শিল্প ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। বহু বঞ্চনা, ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কষ্ট, মালিকদের অন্যায় শ্রমিকদের হৃদয়ে দিনে দিনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সেখান থেকেই উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টার বিপরীতে তারা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি জানাতে জড়ো হয়েছিল। এ ছাড়াও মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নততর পরিবেশ ইত্যাদি দাবিতেও তারা ছিল সোচ্চার। কিন্তু বর্বর পন্থায় সেই ধর্মঘট দমনের চেষ্টা করা হয়। ৩রা মে ধর্মঘটি শ্রমিকদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে ৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। এর ফলস্বরূপ পরদিন হে মার্কেটে শ্রমিকরা প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হলে কারখানার মালিকরা সেখানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তাতে ৪ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ধর্মঘট সংঘটিত করার দায়ে অগাস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এই আন্দোলন, এত রক্ত বৃথা যায়নি। শ্রমিক দিবস পেয়েছে বিশ্ববাসী। এই শ্রমিক দিবস সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগ্রত হওয়ার সাহস জোগায়। শ্রমিকদের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিন এই মে দিবস। সুবিধাবাদীদের বৈষম্যের বেড়াজাল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার দিন এই মে দিবস।
বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণির একটি বড়ো অংশ বর্তমানে নারী শ্রমিক। সকালে ঘুম থেকেই জেগে আমরা দেখি হাজারও নারী শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে হেঁটে চলেছে। তাদের এই পথচলা যেন আমাদের অগ্রসরমান অর্থনীতির চালিকাশক্তি। আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে সকল নারী শ্রমিকের কর্মপরিবেশ। অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত নারীদের মতো এই নারী শ্রমিকদেরও নিশ্চিত করতে হবে মাতৃত্বকালীন ছুটি।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আমরা নারী তথা সকল নারী শ্রমিককে কতোটা সুরক্ষিত রাখতে পারছি এটা একটি বড়ো প্রশ্ন। উল্লিখিত মা কি তার মেয়েকে নিরাপত্তা দিতে পারবে? এই শ্রমিক মায়েদের সন্তানদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। শ্রমজীবী মায়ের শিশুর জন্য চাই নিরাপদ আশ্রয়। ডে-কেয়ার সেন্টার হতে পারে এর একটি সমাধান। শ্রমজীবী মায়ের কিশোরী কন্যাটির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে, যেন কোনো অশুভ কালো ছায়া তাকে গ্রাস করতে না পারে।
হারিয়ে যাওয়া কয়েনটি খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে আজকের কন্যা শিশুটি হয়ে উঠুক আগামীদিনের সকল অন্যায়, আগ্রাসী কর্মকান্ডের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সেইসঙ্গে সকল নির্যাতন-হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক পুরো মানবজাতি, তবেই মুক্তি।
জয় হোক মেহনতি জনতার।
কাহিনীটি খুভ কষ্টকর ।আনাদের দেশে মানুষ ভড় হলে অন্য কাওকে চওখে দেখেনা।