পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে বারবার কেবল নারীকেই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। কেন এই মেনে নেয়া? কী সেই টানাপোড়েন? অন্যের কাছে ভালো হওয়ার নেশা নাকি কোনো দায় মেটানোর চেষ্টা? এমন যদি হতো তার ওপর চেপে বসা সংসারের দায়িত্বগুলো পরিবারের অন্যরাও ভাগ করে নিচ্ছে, তাহলে কেমন হতো সেই জীবন?
আধুনিক সমাজে নারীর জীবনে সুযোগ বেড়েছে, সেইসঙ্গে বেড়েছে দায়িত্ব। এরপরও নারী সব বাধা এখনও কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কি? কোনো কিছু মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার বোঝা সবসময় নারীদের ওপরই বর্তায়। আমরা একটি সমতা ভিত্তিক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সব ক্ষেত্রে নারীরা সমান সুযোগ পাচ্ছে কি?
কেস: ১
অপরাজিতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন আজ প্রায় ২৭ বছর। সহকর্মীরা অনেকে বলেন তিনি নিজেকে নিজেই তৈরি করছেন, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় self-made। বলবেই-না কেন, সেই ছাত্রজীবন থেকে জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। এখনও আছেন একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে। দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে নিজের অবস্থান ও মর্যাদা ধরে রেখেছেন। আপসহীন একজন লড়াকু, স্পষ্টভাষী মানুষ বলেই সবাই তাকে জানে।
করোনাকালে এক সন্ধ্যায় তিনি যখন বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছিলেন, তখন চোখে পড়ল স্বামীর রেখে যাওয়া চিরকুট। আর তাতে লেখা ছিল, “ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে।” কিন্তু অপরাজিতা ভাবছে আহা! এমনভাবে সেও যদি বলতে পারত, এককাপ চা যদি তার সামনে এনে কেউ রেখে দিত!
অন্য একদিনের কথা, ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পান চিরকুট, আর তাতে লেখা, “আমার কিছু টাকা লাগবে! কিছুূদিনের মাঝেই ফেরত দেব।” কিন্তু কখনও আর সেই টাকা ফেরত পাওয়া হয়নি।
শাশুড়ি খুব আদরমাখা কণ্ঠে বলেন, “আমাদের পরিবারের সবাই তোমাকে তো আমার ছেলের চাইতেও বেশি পছন্দ করে। আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নাও, নিতে হয়। তাহলে তারা আরও খুশি হবে, দোয়া করবে।”
অপরাজিতার ছেলে বিদেশে পড়ালেখা করে, প্রতিদিন কথা হয় না, মাঝে মাঝে হয়। নিজের মতো করে জীবন গড়ে নেবে-এই আশা থেকে কখনও তার সিদ্ধান্তে কোন বাধা দেয়নি। বরাবরই ছেলের ওপর আস্থা রেখেছেন। কখনও মা হিসেবে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেননি।
যদিও এত টাকা দিয়ে বিদেশে পড়তে পাঠানোর বিষয়টি সহজ ছিল না। ইচ্ছে ছিল ছেলে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতেই পড়বে। কিন্তু তা হলো না। এখন তো প্রায়ই ছেলে মাসের শেষ না হতেই বলে, “মা এ মাসে কিন্তু কিছুটা খরচ বেড়েছে।” ফোন আসে ঘনঘন তারপর প্রয়োজন মিটে গেলে আর কোনো খবর নেই। মায়ের জন্য সময় কোথায়? তীব্র অভিমান জমা হয় বুকের মাঝে, কষ্ট বাড়ে, কিন্তু বলা হয় না। অপেক্ষায় থাকে। ভালোবাসায় আর প্রার্থনায় একমাত্র সন্তানের মঙ্গল কামনায়।
কেস: ২
নীলাঞ্জনা। সমাজ বিজ্ঞানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। একটি বেসরকারি সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। সারাদিন ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন। অনেক বেশি সুযোগসুবিধা পাওয়ার আশায় সরকারি চাকরি ছেড়ে এখানে জয়েন করেছেন। ভালোই আছেন, কর্মব্যস্ত জীবন। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব একহাতেই সামলান।
করোনা মহামারি শুরুর আগে অবসরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে, কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা মঞ্চ নাটক দেখতে যেতে পছন্দ করতেন; আর শপিং- নিজের জন্য বা ঘর সাজানোর জিনিস। ভীষণ ভালোবাসেন বাগান করতে। ছাদকৃষি আর নিজের বারান্দায় ফুলের টবগুলো তার মনকাড়া ফুলে ভরা। কখনও কখনও সেখানে বসে বই পড়েন কিংবা গান শোনেন। রুচিশীল একজন মানুষ।
নীলঞ্জনার স্বামী সরকারি কর্মকর্তা। ঢাকার বাইরে পোস্টিং। মাসে দু-একবার আসেন। পরিবারের সবার সাথে হাসি-আনন্দে ছুটি কাটিয়ে ফিরে যান কর্মস্থলে। পরিবারের কাজে সহযোগিতা করার সুযোগ কখনও পান না, সময় কোথায়? সংসারের যাবতীয় ভাবনা- সন্তান কোথায় পড়বে, কী করবে, কেমন খরচ হবে, কে বহন করবেন সব কিছুর দায়িত্ব নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছেন নীলঞ্জনার ওপর। কারণ নীলাঞ্জনা বেশি বেতন পান, সব কিছু সামলে নিতে পারবেন এবং পারেন। ঘর, অফিস, সামাজিক দায়িত্ব সব।
কেস: ৩
সানজানা কবির। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করেন। দুই ভাইবোন। ছোটো ভাই আমেরিকা প্রবাসী। বিয়ে করে স্ত্রী-সন্তানসহ বেশ ভালোই আছেন। বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে সানজানা থাকেন ঢাকায়। বয়স তিপান্ন কিংবা চুয়ান্ন। সানজানা নিপুণহাতে বাজারঘাট, বাবা-মার চিকিৎসা, যত্নআত্তিসহ সংসারের সব দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কিছুটা অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের কারণে সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করেন।
তিনি একজন সাদামনের মানুষ। ছোটো ভাইটিও ভীষণ মেধাবী, সৃজনশীল ও সংবেদনশীল একজন মানুষ। বছরে দু-একবার আসেন বাবা-মাকে, বোনকে দেখতে।
এই তিনটি কেস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনজন নারীর জীবন কোনো না-কোনোভাবে একই সূত্রে বাঁধা। কী সেই সূত্রের সূচনা বা উৎস? তিনজনই অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল। তারপরও পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে বারবার কেবল তাকেই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। কেন এই মেনে নেয়া? কী সেই টানাপোড়েন? অন্যের কাছে ভালো হওয়ার নেশা নাকি কোনো দায় মেটানোর চেষ্টা? এমন যদি হতো তার ওপর চেপে বসা সংসারের দায়িত্বগুলো পরিবারের অন্যরাও ভাগ করে নিচ্ছে, তাহলে কেমন হতো সেই জীবন?
আধুনিক জীবনের আড়ালেও বেশ স্পষ্টভাবেই রয়ে যাচ্ছে নারীদের বৈষম্য ও বঞ্চনার চিত্র। অপরাজিতা, নীলঞ্জনা আরা সানজানাদের ভালো থাকা বা ভালো আছি এমন ভাবনা তাই কোথায় যেন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পরিবর্তন আসুক আমাদের মানসিকতায়, বদলে যাক এ গল্পগুলো।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা
Very nice and thoughtful. Thanks.