অসহায় মানুষের সহায়তা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি শুধু এটুকুই বললেন, ‘আমার সকল কষ্ট আজ পূর্ণতা পেল। আমার নির্বাচন করা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আজ উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেল। শুনেছি, সৃষ্টিকর্তা বিপন্ন মানুষের অন্তরের কথা শুনতে পান।’
ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কমর্সূচির গণনাটক কাযর্ক্রমের সদাহাস্যময় এবং প্রাণবন্ত কর্মী মিঠুন দত্ত দাদা। তার সাথে আমি আগেও কাজ করেছি। মানুষের সাথে সহজেই মিশে যেতে পারেন, পারেন কমিউনিটিতে নাটক প্রদশর্নীর সময় উপস্থিত দশকর্দের মাতিয়ে রাখতে; যা আমাকে এখনও অনুপ্রাণিত করে। কমিউনিটির সকলের সাথে মিলেমিশে কীভাবে কাজ করতে হয় বলতে গেলে তার কাছ থেকেই শিখেছি আমি।
দীর্ঘদিন আমাদের একসাথে কাজ করা হয়নি। গত জানুয়ারিতে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক হিসেবে যশোর অঞ্চলে দায়িত্ব নেওয়ার পর পুনরায় দাদার সাথে কাজ করার সুযোগ হয়। মিঠুনদা বর্তমানে খুলনার ডুমুরিয়ায় কর্মরত আছেন।
করোনাকালে গণনাটকের সকল ধরনের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও পল্লীসমাজ তথা সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির অংশগ্রহণকারীদের সচেতনতা এবং সহায়তা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। আমাদের নাট্যকর্মীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য প্রথম তিনিই আমাকে প্রস্তাব করেন । তার প্রস্তাবের ভিত্তিতে আমরা আর্থিক সহায়তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নারী নাট্যকর্মীদেরও প্রদান করেছি। এছাড়াও কর্মসূচির অংশগ্রহণকারীদের করোনা সচেতনতায় তার নিজের কিছু গান দারুণ ভূমিকা রেখেছে।
২০শে মে ২০২০, রাত ৮:০০ টা। মিঠুনদার সাথে ফোনে আলাপ, আম্পান প্রস্তুতি নিয়ে। ওপার থেকে দাদা বলছেন, ‘আম্পানের প্রবল বাতাসে মনে হচ্ছে সব উড়ে যাবে। আমি অন্য কর্মসূচির কয়েকজন ভাইয়ের সাথে একটা বিল্ডিংয়ের নিচতলায় আছি। খুব ভয় পাচ্ছি। চারদিকে শুধু গাছপালা ভাঙার শব্দ। মনে হচ্ছে, আমাদের বিল্ডিংটাও কাঁপছে।’ আমি তাকে সাহস দিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পরদিন সকাল ১১:৩০ টা পযর্ন্ত আর যোগাযোগ করতে পারলাম না।
যখন ফোনে পেলাম তিনি রীতিমতো হাহাকার করলেন যেন, ‘আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সকাল হওয়া মাত্র ছুটে গিয়েছি আমার নাট্যকর্মী ও পল্লীসমাজের সদস্যদের বাড়ি। আপনার ম্যাসেনজারে কয়েকটা ছবি পাঠালাম। চারিদিকে শুধুই ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। এত ভয়ংকর ঝড় আমি আগে কখনও দেখিনি। যেভাবে মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে তাতে আমাদের পাশে দাড়াঁনো উচিত।’
আমি তাকে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করতে অনুরোধ করলাম। বললাম, ‘মানবিক সহায়তা কর্মসূচি থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাদের ঘর ঝড়ে ভেঙে পড়েছে বা অন্যান্য ক্ষতি হয়েছে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। করোনা ও আম্পানের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন, তাই আপনার সহায়তা দরকার।’
এসব কথাবার্তা ফোনেই হচ্ছিল। দাদা মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে তার শক্তিতে পরিণত করলেন। তৎক্ষণাৎ তার সরল উক্তি প্রায়ই আমার কানে বাজে, ‘আমার তো মোটরসাইকেল আছে আমি দ্রুত যেতে পারব।’
রমজানের ঈদের আগেরদিন। বেলা ১০টাও তখনও বাজেনি,পাইকগাছা পৌঁছে গেলেন তিনি। মানুষের পাশে দাঁড়াতে কেউ কেউ সময়ের আগে ছোটেন।
এরপর তাকে আর কিছু বলতে হয়নি, তিনি একের পর এক ফোন করতে লাগলেন। পল্লীসমাজের সদস্যদের ঠিকানা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো চিহ্নিত করার কাজ শুরু করলেন। তিনিই সর্বাগ্রে পাইকগাছা উপজেলার ৫২জন সদস্যের তথ্য দিতে পারায় উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিও সন্তুষ্ট। মিঠুনদা, আপনিই আমাদের কাজের গতি এনেছেন, না হলে সময়মতো উপকারভোগী নির্বাচন করা কঠিন হতো।
দুর্যোগের ভয়াবহ অনুভূতি কখনও কখনও প্রকাশ পায় মানুষের সৃজনশীল সত্তায়। আম্পানের ভয়াবহতার অসংখ্য ছবি নিজের মোবাইলে দিয়ে তুলেছেন মিঠুনদা, যেখানে এই ঝড়ের ভয়াবহতা এবং প্রকৃতির তান্ডব ফুটে উঠেছে অত্যন্ত করুণভাবে।
মিঠুনদা তার কাজের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল; বিনয় তার চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। অসহায় মানুষের সহায়তা নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি শুধু এটুকুই বললেন, ‘আমার সকল কষ্ট আজ পূর্ণতা পেল। আমার নির্বাচন করা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আজ উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেল। শুনেছি, সৃষ্টিকর্তা ঘরহারা বিপন্ন মানুষের অন্তরের কথা শুনতে পান । আমি খুব সন্তুষ্ট, আজ ৭টি দিন কাদা-জলের মধ্যে যে লড়াই করলাম তা সার্থক হলো।’
ঈদের ছুটির মায়া ত্যাগ করে ব্র্যাকের অনেক কর্মী ছুটে গিয়েছিলেন মানুষের পাশে। সুপার সাইক্লোন আম্পানে ঘর হারানো পল্লীসমাজ, নাট্যকর্মী , ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের দ্বারে-দ্বারে গিয়েছেন সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির কর্মীরাও। মাথোগোঁজার ঠাঁইটুকু লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া এ সকল সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়ে আমরা অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। কর্মীরা নিজেদের ঈদ-আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন সহায়-সম্বলহীন মানুষের পাশে থেকে।
আমাদের মিঠুন দাদাও তাদের একজন। নিকটাত্মীয়দের থেকে দূরে আছেন, কিন্তু মানবতার শক্তিতে তিনি নির্ভয়ে কাজ করছেন দেশের মানুষের পাশে থেকে। সংকটে মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়া এ সকল মানব সারথিরা কালের পরিক্রমায় স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে থাকবেন।
সম্পাদনা এবং সমন্বয়- তাজনীন সুলতানা, শাহাদাত হোসেন
Salut.