মানুষের সেবায়, মানুষের পাশে

May 12, 2020

অবসর নেওয়ার পরে শেষ সম্বল দেড় লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ছেলেটি এক দালালের পাল্লায় পড়ে যায়। ওই দালাল তাকে কিডন্যাপার চক্রের হাতে তুলে দেয়। এখন সেই চক্র তাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে যে, টাকা না পাঠালে ছেলেকে ছাড়বে না।

২০১৫ সালের ঘটনা। একদিন দুপুরে অফিসে বসে কাজ করছি। এমন সময় একজন এলেন। ‘স্যার আসতে পারি’ শুনে অবাক হয়েই তাকালাম। কারণ আমাদের গ্রাহকরা ভাই বলে ডাকে। যিনি এসেছিলেন তার বয়স ৬৫ বছর হবে। চেহারার মধ্যে বয়স ও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তাকে ভেতরে এসে বসতে বললাম। কিন্তু তিনি কিছুতেই বসবেন না। অনুরোধ করার পরে বসলেন।

বসেই লোকটা অঝোরে কাঁদতে থাকলেন। আমি শান্ত করার চেষ্টা করলাম। একটু পরে স্বাভাবিক হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘বাবা, আমার ছেলে সৌদি আরব গেছে ৩ মাস। কিন্তু ওখানে যাওয়ার পরে কারা যেন ওকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাকে প্রতিদিন ওকে নির্যাতনের ভিডিও পাঠাচ্ছে আর টাকা দাবি করছে।’ মোবাইলে ছেলের ছবিও দেখালেন। ছেলের বয়স ২৫ এর মতো হবে। কথায় কথায় জানলাম, তিনি সেনাবাহিনীর একজন রিটায়ার্ড সার্জেন্ট। অবসর নেওয়ার পরে শেষ সম্বল দেড় লাখ টাকা খরচ করে ছেলেকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ছেলেটি এক দালালের পাল্লায় পড়ে যায়। ওই দালাল তাকে কিডন্যাপার চক্রের হাতে তুলে দেয়। এখন সেই চক্র তাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে যে, টাকা না পাঠালে ছেলেকে ছাড়বে না।

তিনি বললেন, এ পর্যন্ত দুই দফায় টাকা দিয়েছি। প্রথমে ৫০ হাজার এবং কিছুদিন আগে আবার ২৫ হাজার। এখন তারা বলছে আমি যদি আরও ৩৫ হাজার টাকা অর্থাৎ প্লেন ভাড়াটা দেই, তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো যে, এবার টাকা দিলে ছেড়ে দেবে? এত টাকা আমি কোথায় পাব? এদিকে ছেলেকে প্রতিদিন নির্যাতন করে ভিডিও পাঠাচ্ছে। ওই ভিডিও বাবা হিসেবে আমার পক্ষে দেখে সহ্য করা সম্ভব নয় বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না। দেখি কী করা যায়। ছেলে ফিরে আসবে বলে তাকে আশ্বস্ত করলাম।

তখন বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে সরাসরি টাকা পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দালালরা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাতে বলত। নোয়াখালীতে দালালের এক আত্মীয়ের কাছে বিকাশ করে টাকা পাঠালে তা দালাল চক্রের হাতে পৌঁছে যেত। এই দফায় এভাবে টাকা পাঠাতে নিষেধ করলাম। বললাম, এভাবে দিলে না ছেড়ে আবারও আটকে রাখতে পারে। তাকে পুলিশের সহায়তা নেওয়ার কথা বলতেই তিনি বললেন, কোনোভাবেই এটা করা যাবে না। পুলিশ তো দূরে থাক, আমি আপনাদের কাছে যে এসেছি, তা জানলেই ওরা ছেলেকে মেরে ফেলবে। এই ঝুঁকি তিনি কোনোমতেই নিতে রাজি নন। বরং শেষ দফায় টাকা পাঠানোর জন্য তিনি প্রস্তুত। টাকার বিনিময়ে হলেও প্রিয় ছেলেকে সুস্থভাবে ফেরত পেতে চান।

সব শুনে আমি পথ খুঁজতে লাগলাম। শেষে সৌদি আরবের ওই শহরেই থাকে এরকম একজনকে খুঁজে পেলাম এবং তার কাছে টাকা পৌঁছলাম। সে পরিচিত একজনের মাধ্যমে দালাল চক্রকে টাকা পৌঁছে দিয়ে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলো। এর ৭ দিন পরেই ছেলে বাংলাদেশে ফিরল। ফিরে আসার সঙ্গেসঙ্গেই ছেলেকে নিয়ে সেই বাবা অফিসে এসে হাজির। এসেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর কৃতজ্ঞতার হাসি ও উচ্ছ্বাস কখনই ভোলার নয়।

আমি ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচিতে কাজ করছি ২০০৭ সাল থেকে। ব্র্যাকে আছি ১৫ বছর। বর্তমানে ঢাকার রিইন্টিগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার (আরএসসি)-এর ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছি। রিইন্টিগ্রেশন সার্ভিস সেন্টার মূলত বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে ও অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে সহায়তা করে। এ ছাড়াও বিদেশে যারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, তাদেরকে মানসিক কাউন্সেলিং সেবাও দিয়ে থাকে।

মাইগ্রেশন কর্মসূচিতে আমার প্রথম পোস্টিং ছিল রংপুরে। তখন রংপুরের মানুষ বিদেশে কম যেত। বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করার জন্য আমি কাজ শুরু করলাম। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হলো। কিন্তু একটা সমস্যা রয়েই গেল। দেখা যেত যে, মানুষ বিদেশ গিয়ে নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই ভাষা না জানার কারণে বিদেশে গিয়ে প্রতিদিনের জীবন চলায় এবং কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। এই সমস্যা দূর করতে আমি তখন রংপুর এলাকায় একটি ভাষা শিক্ষা দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করি। যদিও এর জন্য তখন ব্র্যাকের পক্ষ থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয় নি। অনেকে উপকৃত হবে এই ভেবে নিজ উদ্যোগেই সেই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।

আরেকটি স্মরণীয় স্মৃতি আছে। ২০১৬ সালের কথা। লেবাননে কর্মরত এক নারীশ্রমিক, নাহিদা (ছদ্মনাম) স্ট্রোকে মারা যান। তার বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায়। মারা যাওয়ার পরে তার লাশ বেশ কিছুদিন সে দেশের মর্গে ছিল। এক সময় মর্গের খরচবাবদ বিল চলে আসে ১৩ লাখ টাকা! কিন্তু নাহিদার দরিদ্র বাবা-মায়ের পক্ষে এই টাকা কোনোভাবেই পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সাফ জানিয়ে দেন, আমরা নিজেরাই ঠিকমতো খেতে পাই না, সেখানে এতগুলো টাকা দিয়ে কীভাবে মেয়ের লাশ দেশে আনব? আমরা লাশ আনতে চাই না। আসলে অসহায় বাবা-মায়ের এরকম করা ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্পই ছিল না।

আমরা তাদেরকে বুঝিয়ে বললাম, কোনো টাকা খরচ হবে না। আপনার মেয়ে যেহেতু বৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বিদেশ গেছে, সুতরাং তার লাশ আনার দায়িত্ব সরকারের। সবকিছু আমরাই করে দেব। আপনারা শুধু কাগজপত্রে সই করে দেবেন। তখন নাহিদার মা রাজি হলো। এরপর তিন মাস আমিসহ মাঠকর্মীদের পরিশ্রমের ফলে লাশ দেশে এনে বাবা-মাকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলাম। এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অনেক সহযোগিতা করেছিল। নাহিদার পরিবার লাশ দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা এবং তার মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ আরও ৩ লাখ টাকা পেয়েছে, যা দিয়ে তার পরিবার এখন স্বচ্ছন্দে চলতে পারছে। ব্র্যাকই এই টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

আমাদের প্রচেষ্টার কারণে নাহিদার লাশ যখন মানিকগঞ্জের সিংগাইরে এসে পৌঁছায়, তখন এলাকার মানুষের মধ্যে ব্র্যাককে নিয়ে সাড়া পড়ে যায়। সকলের মুখে মুখে তখন ব্র্যাকের সুনাম। তারা মাইগ্রেশন বা মাইক্রোফাইন্যান্স আলাদা করে বুঝত না। কিন্তু সকলেই বলত, ব্র্যাক বলেই সম্ভব হয়েছে।

ব্র্যাকে কাজ করতে গিয়ে বহু মানুষকে সহায়তা করেছি, বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছি। যতটুকু করা সম্ভব, করেছি। এবারে মূল্যবোধ পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে ব্র্যাক আমার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। এজন্য আমি খুশি এবং কৃতজ্ঞ। কিন্তু ছেলেকে ফিরে পেয়ে তার বাবার আমাকে জড়িয়ে ধরা, মেয়ের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনায় নাহিদার পরিবারের অসীম কৃতজ্ঞতাবোধ কিংবা সেবাগ্রহীতাদের হাসিমাখা মুখ-দিনশেষে এগুলোই  জীবনের সবচাইতে বড় প্রাপ্তি, বড় স্বীকৃতি।

 

অনুলিখন : মার্সিয়া আমিন ও শাহাদাত হোসেন

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments