মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন

July 28, 2020

জীবন এবং জীবিকা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্তর সামনে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিকার সন্ধানে থাকা মানুষগুলো আজ অপ্রিয় অথচ কঠিন সত্যের মুখোমুখি। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবনের জীবিকা রক্ষাও এখন বড়ো ব্রত। ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঢুঁ দিলেই দেখা যাবে পরিপাটি বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট লেখা সাইনবোর্ড। পাড়ার মোড়ের দেয়ালগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ছেয়ে থাকে অথচ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে টু-লেট, সাবলেট অগণিত বিজ্ঞাপন।

দু’পা এগিয়ে বকুল যে সাহায্য করবে, সেই সুযোগ প্রকৃতি বকুলকে দেয়নি। প্রকৃতিতে তার জন্ম হয়েছে একটি বৃক্ষ হিসেবে। আজ সে সুযোগ থাকলে বকুল ঠিকই এগিয়ে যেতো বড়ো রাস্তার মোড় পর্যন্ত। বকুল বৃক্ষের চোখ থাকলে নিশ্চয় ঝরে পড়তো অশ্রু। আজ যে বিদায়ের পালা।

ঠিক পনেরো বছর আগে এমন একটি দিনে রহমত সাহেব তার কন্যার জন্মের দিন বকুল বৃক্ষটিকে কিনে আনেন দূর নার্সারি থেকে। এরপর ছোট্ট কন্যাটির বেড়ে ওঠা এই বকুলকে ঘিরেই। জীবনের দাবি মেটাতে রহমত সাহেব আজ রাজধানী ছাড়ছেন।

কোনো এক ভোরের আলোতে রহমতের ঢাকায় আসা জীবন গড়ার তাগিদে। অনেক স্বপ্ন ছিল সেই আলোক ছটায়। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল। কন্যা স্কুলের গণ্ডি পেড়িয়ে এবছর কলেজের মুখ দেখবে, পুরো পরিবার জুড়েই চলছিল এক অদ্ভুত অনুভূতি। চাকরিটা ছোটোখাটো হলেও কন্যার পড়াশুনায় কোনো ঘাটতি রাখেননি তিনি। কিন্তু করোনা ছায়া এসে পড়ল রহমত সাহেবের মধ্যবিত্ত সংসারে। টানাপোড়েনের জীবনে সেই ছায়া ক্রমশ অন্ধকার হতে শুরু করল, অবশেষে চক্ষুলজ্জায় ভীত হয়ে রাতের নিকষ অন্ধকারে তার স্বপ্নের শহরকে পেছনে ফেলে। বকুল বৃক্ষটিই রহমত সাহেবদের রাজধানী ছাড়ার নীরব সাক্ষী।

জীবন এবং জীবিকা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্তর সামনে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবিকার সন্ধানে থাকা মানুষগুলো আজ অপ্রিয় অথচ কঠিন সত্যের মুখোমুখি। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে থাকা মানুষগুলোর জীবনের জীবিকা রক্ষাও এখন বড়ো ব্রত। ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঢুঁ দিলেই দেখা যাবে পরিপাটি বাড়িগুলোতে ঝুলছে টু-লেট লেখা সাইনবোর্ড। পাড়ার মোড়ের দেয়ালগুলো বছরজুড়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টারে ছেয়ে থাকে অথচ সেখানে জায়গা করে নিয়েছে টু-লেট, সাবলেট অগণিত বিজ্ঞাপন।

সাবলেট অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয় না। এখানে কোনো ছোটো পরিবারের এক রুমের বাসা ছিল। কিন্তু করোনার থাবা তাদের সেই আশ্রয়ও কেড়ে নিয়েছে। নিদারুণ কষ্টের এসব কথা অন্যকে বলা যায় না। কর্মহীনতার কষ্ট, না খেয়ে দিনযাপন এগুলো হয়তো বড়োরা করল, কিন্তু বাড়ির ছোটো ছেলেমেয়েগুলো? তাদের ক্ষিদের কষ্ট, স্কুলে না যাওয়ার কষ্ট কিংবা আবদার করা চিপস্-এর প্যাকেট কিনে দিতে না পারার কষ্ট মধ্যবিত্ত সমাজ কার কাছে জানাবে?

চাকরি কিংবা ছোটোখাটো ব্যবসা হারিয়ে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত যেটাই বলি না কেন সকলেই আজ অথৈ সমুদ্রে। সেই সমুদ্রের ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য পরিবারগুলোও। এলাকা থেকে একজন ভাড়াটিয়া চলে যাওয়ার অর্থ, সে মানুষটি যে মুদি দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করত বিপদটা দোকানদারের ঘাড়েও এসে পড়ল। ইদানীং শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী। এই যেমন বাচ্চাদের খেলনাওয়ালা, ডাবওয়ালা, সবজিওয়ালা ইত্যাদি। এরা অনেকেই এ পেশায় নতুন, পুরোনো কাজ হারিয়ে নতুন পেশা বেছে নেওয়া অর্থাৎ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নিম্ন-মধ্যবিত্ত তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই বয়সে কিশোর বা তরুণ। শুধুমাত্র পরিবারকে রক্ষা করতে বইখাতা ফেলে ভ্যানগাড়ির হাতলে চেপেছে তাদের হাত।

দৃঢ় মমতায় বেড়ে ওঠা এ শহরে মানুষগুলো যে শুধুমাত্র করোনার ভয়েই শহর ছাড়ছে তা কিন্তু নয়। বরং কর্মহীন এই মানুষগুলো হারাচ্ছে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই। অল্প উপার্জনের মধ্যবিত্ত পরিবারটি কীভাবে তাদের বাড়ি ভাড়া মেটাবে? নেই সেই নিশ্চয়তা। এ ছাড়া গলার কাঁটা হিসেবে যোগ হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল। আবার বাড়ির মালিকও রয়েছে বিপদে। ব্যাংক ঋণে গড়া বাড়ি, তাকেও তো বকেয়া মেটাতে হয় মাস শেষে। তাই মানুষ ক্রমশ দরিদ্র হচ্ছে।

ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, করোনায় আয় কমেছে ৯৫ শতাংশ মানুষের। কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ আর কর্মহীন ২৮ শতাংশ মানুষ। (সূত্র: প্রথম আলো) যা নিঃসন্দেহে এ দেশের অর্থনীতিতে একটি বড়ো আঘাত বলা যায়। তাই গ্রামে ফেরা মানুষগুলোকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে আবার অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে।

বাঙালি সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা জাতি। ইতিহাসের পাতায় এই সংগ্রামের গল্পগুলো আমরা দেখতে পাই। অন্যের বিপদে এ দেশের মানুষ যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনি বিপদ শেষে আবারও সবকিছু গড়তে সহায়তা করে। অবশ্য এবারের বিপদ অন্য দশটা বিপদের মতো নয়। এখন ঘরে থেকে সংগ্রাম করার সময়। একদিকে করোনা থাবা আবার অন্যদিকে ধেয়ে আসা বন্যার সর্বগ্রাসী জল।

যদিও সময়টা এখন আমাদের বিরুদ্ধে, তবু প্রতিকূলতার এই ছায়া সরিয়ে আমাদের ঘরে প্রবেশ করাতে হবে আলো। সময়ের এই ঘড়ির কাঁটা একদিন আবার আমাদের পক্ষে আসবেই। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে হতে হবে আরও মানবিক ও সহনশীল। করোনা যুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধাদের বীরত্বের কথা উঠে আসছে প্রতিদিন। ডাক্তার, পুলিশসহ নানান পেশার মানুষের পাশাপাশি অনেকে নিজ উদ্যোগে, নীরবে নিভৃতে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। গ্রামে-গঞ্জে-ইউনিয়নে-পাড়ায়-মহল্লায় ব্র্যাককর্মীরাও তাদের সাধ্যমত অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন।

তাই মনে বিশ্বাস রাখি, সুদিন ফিরবেই!

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত

3.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments