ডায়েরির পাতা থেকে

December 24, 2023

২০২১ সালের কথা। সেদিন ‘ব্র‍্যাক পরিবার দিবস’ উপলক্ষ্যে অফিসে সাজ সাজ রব। সবাই মিলে কানাইঘাটের ‘লোভাছড়া চা বাগান’ ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করেছে। কে কী করবে, কী কী আয়োজন থাকবে এ নিয়ে কত কথা! আমি অফিসের কাজ করছিলাম আর ভাবছিলাম আমার তো যাওয়া হবে না!

‘আমি পারি’ এই বোধ আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আপনি হয়তো ভাবছেন, এ তো সাধারণ কথা!  বলার দরকার কী? আমি এ কথা বলছি কারণ, শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে আগে আমার যে ধরনের শঙ্কা ও সংকোচ ছিল তার অনেকটাই এখন কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আমার জীবনকে সহজ ও সাবলীল করতে অনেকে সাহায্য করেছেন। কিছু কিছু ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে মনোবল। আজ সে গল্পটাই বলব। আমি নিটন লাল দাস। ব্র‍্যাক কানাইঘাট শাখায় হিসাব বিভাগে কর্মরত আছি।

দুই ভাই-বোনের মধ্যে আমি বড়। প্রতিবন্ধিতা সত্ত্বেও আমি যেন অন্য দশজনের মতো স্বাবলম্বী হতে পারি সেজন্য আমার বাবার চেষ্টার কমতি ছিল না। আমার পড়ালেখা শেখার ব্যাপারে তিনি সবসময়ই সচেতন ছিলেন। আমি সিলেট মডেল স্কুল থেকে এসএসসি এবং সিলেট সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর মদনমোহন কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিং-এ অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করি। এরপর অবশ্য আমি খানিক হতাশাগ্রস্তই ছিলাম। কারণ যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার পরও দীর্ঘদিন আমাকে বেকার থাকতে হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণেই আমি হয়তো কিছু করতে পারছি না এবং পারবও না।

একদিন ব্র্যাকের এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে এবং আমি আবেদন করি। যে বিষয়টি ভালো লেগেছিল তা হলো বিজ্ঞপ্তির একাংশে লেখা ছিল, আর্থসামাজিক পরিচয় নির্বিশেষে সমসুযোগভিত্তিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাক নারী, লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে চাকুরিতে আবেদনের জন্য উৎসাহ প্রদান করে।

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও মনে ভয় ছিল, সরাসরি ইন্টারভিউ দিতে গেলে আমাকে দেখে হয়তো তারা নির্বাচন করবেন না। আমার ধারণা ভুল ছিল। নিয়োগের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে আজ আমি একজন ব্র্যাককর্মী। আমার এই ব্র্যাকজীবনের দুটো ঘটনা না বললেই নয়-

২০২১ সালের কথা। সেদিন ‘ব্র‍্যাক পরিবার দিবস’ উপলক্ষ্যে অফিসে সাজ সাজ রব। সবাই মিলে কানাইঘাটের ‘লোভাছড়া চা বাগান’ ঘুরতে যাবে বলে ঠিক করেছে। কে কী করবে, কী কী আয়োজন থাকবে এ নিয়ে কত কথা! আমি অফিসের কাজ করছিলাম আর ভাবছিলাম আমার তো যাওয়া হবে না! এত দুর্গম রাস্তায় আমার যাওয়া মানে অনেক কিছুর আয়োজন আলাদাভাবে  করতে হবে। সেটা কি আর সম্ভব?

অন্যরা আমাকে বলবে তোমাকে নিতে পারছি না, তার চাইতে আমার আগেই মানা করা উচিত-এই ভেবে  আমি সবাইকে জানালাম, আমার ভালো লাগছে না। আমি বরং না যাই। কিন্তু দেখা গেল আমার সহকর্মীরা তা মানতে নারাজ। আমাকে সঙ্গে না নিয়ে তারা যাবে না। আমি কীভাবে যাব সে পরিকল্পনাও করা হয়ে গেল। অবশেষে একজন সহকর্মীর মোটরসাইকেলে করে সেদিন আমি গিয়েছিলাম। সারাদিন কী যে আনন্দে কাটল!

আরেকটি ঘটনা যেন না বললেই নয়। এই কিছুদিন আগে অফিসে ‘জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি’ কর্মসূচির ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। আমি জানিয়েছিলাম সেখানে একটি বিশেষ ধরনের চেয়ার আমার জন্য থাকলে সুবিধা হবে। মাত্র দুই দিনের মধ্যে অ্যাকাউন্টসের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

পরিশেষে ব্র্যাক লিম্ব অ্যান্ড ব্রেইস সেন্টারের কথা বলতে চাই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই সেন্টার থেকে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন, ব্রেইস এবং ফিজিওথেরাপি সেবা পেতে পারেন। দুর্ঘটনায় আহত অনেকে কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের মাধ্যমে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।

অফিসের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারছি-এটা সত্যিই অত্যন্ত সুখকর অনুভূতি। অফিসের বিভিন্ন কাজে, অফিস শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা, ছুটির দিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া সবকিছুতেই যখন আমি যোগ দিই তখন সত্যিই খুব ভালো লাগে। আমি হয়ে উঠি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শাকিল মান্নান
শাকিল মান্নান
4 months ago

নিটন ভাই, আপনার গল্প আশাকরি আরো অনেককেই উৎসাহিত করবে। একজন ব্র‍্যাক কর্মী হিসেবে গর্ব বোধ করছি আপনার গল্প পড়ে। আগামীতে আপনি আরো এগিয়ে যাবেন এই কামনা করছি। ভালো থাকবেন।

Last edited 4 months ago by শাকিল মান্নান