কৃষ্ণাদি সাইকেলে যাতায়াত করেন। এই সাইকেল শুধু তার পথচলাকেই মসৃণ করেনি, বরং প্রতিনিয়ত বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল জুগিয়েছে। কীভাবে?
কৃষ্ণাদির এখনও মনে পড়ে সেই দিনের কথা, সারাদিন কিস্তির টাকা তুলে সাইকেল নিয়ে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ঘাটে গিয়ে দেখেন নৌকা রেখে মাঝি চলে গেছে। অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া গেল না। অথচ মাঝি জানেন এ পথেই ফিরবেন তিনি। এই দুর্যোগে কোনো মানবিকতাই দেখাল না সে।
কৃষ্ণাদি তখন এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন। নৌকা চালানো একটু-আধটু জানতেন, নদী তো পার হতেই হবে, অগত্যা কাদাপানি ঠেলে বহু কষ্টে সাইকেলটি নৌকায় রেখে হাতে তুলে নিলেন বৈঠা। নৌকা বাইতে গিয়ে দেখা গেল তিনি যাবেন ‘বাহির চর’ কিন্তু স্রোতের টানে চলে গেছেন অন্য এক ঘাটে। কী যে কষ্ট করে সেদিন অফিসে ফিরেছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে শান্তি পান একথা ভেবে যে, সেই মাঝি ভাই এখন তার কর্মসূচির সদস্য।
কৃষ্ণাদি এমনই! কোনো কিছু করবেন ভাবলে তার সম্পন্ন করার জন্য ভীষণ চেষ্টা করেন। ছোটবেলায় মনে মনে ঠিক করেছিলেন বড় হয়ে অনেক টাকা আয় করবেন আর সেই টাকা দিয়ে বাবাকে সাহায্য করবেন। পরবর্তীতে যখন প্রয়োজন হলো তখন তা তিনি করেছেন।
কৃষ্ণাদির বাবা চার ছেলেমেয়েকেই পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। বড় বোনের প্রাইমারি স্কুলে চাকরি আর বিয়ে হলো প্রায় একই সময়ে। তিনি নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখন বাবার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। ভাই-বোনের পড়ার খরচ জোগাতে কৃষ্ণাদিকেই এগিয়ে আসতে হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে ফরিদপুরের বিল নালিয়া ময়েজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেই কৃষ্ণাদি যুক্ত হন ব্র্যাক এর শিক্ষা কর্মসূচিতে। কৃষ্ণা রাহা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন সফল শিক্ষাকর্মী “কৃষ্ণাদি”।
শিক্ষার্থীদের জন্য সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে কৃষ্ণাদি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি ব্র্যাক প্রাথমিক স্কুলের পাশাপাশি সংস্থার আরও একটি স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিশোর-কিশোরীরা সেই স্কুলে পড়ালেখা করত।
১৯৯৯ সালে এসে কৃষ্ণাদি অন্যভাবে জীবনকে সাজাতে চাইলেন। তিনি যোগ দিলেন বরিশালের বাবুগঞ্জ এলাকায় ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্সের কর্মসূচি সংগঠক পদে।
নতুন দায়িত্বে যোগদানের প্রথম দিনেই পড়লেন অঘটনের মুখে। একজন গ্রাহক পলাতক! ভয় পেয়ে ভেবেছিলেন চাকরিটাই ছেড়ে দেবেন। রিজিওনাল ম্যানেজার তাকে ভরসা দিলেন এই বলে যে, চ্যালেঞ্জ আসবেই, দেখবেন তার সমাধানের পথও আছে। সেই থেকে তার মনোবল আরও দৃঢ় হলো।
১৯৯৮ সালের বন্যার পর অনেকে কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি তখন সবে নতুন যোগদান করেছেন, তাকে দেওয়া হয় ৬টি গ্রাম সংগঠনের দায়িত্ব। সেসময় প্রতিটি ধাপে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনে তিনি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে কিস্তির টাকা ফেরত আনতে তিনি সফল হয়েছিলেন। এরপর তাকে দেওয়া হয়েছিল ১২টির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব।
কৃষ্ণাদি সাইকেলে যাতায়াত করেন। এই সাইকেল শুধু তার পথচলাকেই মসৃণ করেনি, বরং প্রতিনিয়ত বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল জুগিয়েছে। কীভাবে? এর উত্তরে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত গ্রামে একজন মেয়ে সাইকেল চালাচ্ছে দেখে সময়-অসময়ে কত কটু কথা শুনতে হতো, অনেক সময় নানা হেনস্তারও শিকার হতে হয়েছিল। তখন তিনি সাহস নিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছেন। এই পরিস্থিতি তাকে অনেক কিছু দৃঢ়ভাবে সামলে চলা শিখিয়েছে।
আন্তরিকতা ও নিজের দায়িত্ব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে চান, এই দুই কারণেই কৃষ্ণাদি মানুষের মনে আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। তার অভ্যাস হচ্ছে আসা-যাওয়ার পথে এলাকায় সকলের সঙ্গে কথা বলা, তাদের সাথে কুশল বিনিময় করা। যখন কারও সঙ্গে পরিচিত হন কিংবা সদস্যদের বাসায় যান তখন তিনি নিজের কাজের পাশাপাশি ব্র্যাক কী কী ধরনের কাজ করে তাও জানান। আর কেউ যদি সহায়তা চায় তাহলে তো অবশ্যই প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা কীভাবে পেতে পারেন তা নিয়েও আলাপ করেন।
দীর্ঘ বারো বছর প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি কৃষ্ণাদি পড়ালেখাও শেষ করেছেন। তিনি মাস্টার্স পাস করে এখন বরিশাল জেলার, শায়েস্তাবাদের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়েছেন।
কৃষ্ণাদির এই সফল পথচলার সেরা প্রাপ্তি হলো, ২০২২ ও ২০২৩ সালে তিনি ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি থেকে “বেস্ট পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড” লাভ করেছেন।