হাতের কাছে কৃষি ডাক্তার!

August 22, 2023

জাহানারা গিয়ে দেখলেন সেখানে পরিচিত অনেকেই এসেছে। কারও কারও হাতে আছে কার্ড। অন্যরা তাকে জানাল, একে ‘শস্য কার্ড’ বলে। যার নামে কার্ড তার জমি ও ফসলের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাতে লেখা থাকে। জাহানারা বললেন, “আমার তো কার্ড নাই!”

জাহানারা তার মরিচগাছের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ব্র্যাকের ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিকে গেলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কোঁকড়ানো পাতাসহ মরিচগাছের একটি ডাল। দেখাতে হবে কী হাল হয়েছে তার গাছের! তা না হলে ডাক্তারসাব রোগ ধরবেন কীভাবে?

একটু একটু করে পাতাগুলো কুঁকড়ে যাচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন পোকা ধরেছে, বাজার থেকে যা হোক একটা ওষুধ কিনে দিলেই হলো। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না।

একসময় খেতের সবগুলো গাছ আক্রান্ত হলো। এবার জাহানারার কপালে দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ফসল নষ্ট হলে চলবে কেমন করে? একদিন শোনেন, গ্রামে ব্র্যাকের ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিকের লোকেরা আসবে। মাইকিং করে বলা হচ্ছে, চাষাবাদ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন থাকলে সেখান গিয়ে পরামর্শ নিতে পারে।

জাহানারা ভাবলেন, বাড়ির কাছেই এসেছে যখন আগে তাদের কাছেই যাই।

গ্রামের বাজারের খোলা জায়গায় বসেছে এবারের ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিক। কৃষি সমস্যা সমাধানের জন্য এই ক্লিনিকের কর্মকর্তাগণ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় বসেন। সাধারণত যেখানে লোকজনের সমাগম বেশি সে স্থানকেই তারা বেছে নেন। আগে থেকেই গ্রামে মাইকিং করে জানিয়ে দেওয়া হয় কবে কোথায় তারা থাকবেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের সমস্যার কথা শুনছেন ব্র্যাককর্মীরা

বাজারের যে জায়গায় ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালিত হবে জাহানারা সেখানে গিয়ে দেখেন পরিচিত অনেকেই এসেছে। কারও কারও হাতে আছে কার্ড। অন্যরা তাকে জানাল, এটাকে বলে ‘শস্য কার্ড’। যার নামে কার্ড তার জমি ও ফসলের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ তথ্য তাতে লেখা থাকে। জাহানারা বললেন, “আমার তো কার্ড নাই!” অন্যরা জানাল কার্ড না থাকলেও পরামর্শ দেওয়া হয়।

সেক্টর স্পেশালিস্ট (যাদের গ্রামের লোকেরা কৃষি ডাক্তার বলে সম্বোধন করেন) জাহানারা বেগমকে নিম পাতা পানিতে ভিজিয়ে রেখে সেই পানিতে ১/২ চামচ ডিশওয়াশ বা বাসন ধোয়ার সাবান মিশিয়ে কয়েকদিন মরিচগাছে স্প্রে করতে বললেন। আরও বললেন, কীভাবে জৈবসার  তৈরি করে মরিচগাছে ব্যবহার করতে পারেন।

জাহানারা পটুয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রাম নিজশিববাড়িয়ায় থাকেন। স্বামীকে হারিয়েছেন আজ বেশ কয়েক বছর হয়েছে। সংসার চালাতে তাই অন্যের জমি বর্গা নিয়ে সবজি চাষ করেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব অঞ্চলে ফলন ভালো হয় না সেখানে মূলত কাজ করছে এডাপটেশন ক্লিনিক। ২০২২ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ব্র্যাকের ১০টি এডাপটেশন ক্লিনিকের মাধ্যমে সাতক্ষীরা, জামালপুর, যশোর, পটুয়াখালী, নওগাঁ জেলার ৪ হাজারেরও বেশি কৃষক তাদের সমস্যা সমাধানে বিনামূল্যে পরামর্শ পেয়েছে।

ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিকে কৃষিসেবা নিতে এসেছেন কৃষকেরা

ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিক ছাড়াও রয়েছে এডাপটেশন ক্লিনিক অফিস। সেখান থেকে কর্মীরা মাঠে যান, খুঁজে বের করেন কারা জমি অনাবাদি ফেলে রেখেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেন, কী সমস্যার কারণে চাষাবাদ করতে পারছেন না। বেশিরভাগই বলেন ভালো ফসল হচ্ছে না তাই চাষ করি না বা অন্য নানা সমস্যার কথা। সেইসঙ্গে কর্মীরা আরও জেনে নেন কৃষকের মোট জমির পরিমাণ, জমিতে আগে কী কী ফসল হতো, কেমন ফলন হতো, কতদিন ধরে জমিতে ফলন হচ্ছে না-এসব খুঁটিনাটি বিষয়গুলো। তারপর সেগুলো সার্ভিস রেজিস্টারে তুলে নেন। সেই প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া যায় সেক্টর স্পেশালিস্ট বা ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার কাছ থেকে। অবশ্য তাদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে কর্মীরাও অনেকসময় কৃষকদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর জানিয়ে দেন। মোট কথা যে যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেভাবেই তাদেরকে সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো জানিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই একে একে সবাই সমস্যার সমাধান পেয়ে যান কিন্তু কোনো ফি দিতে হয় না।

অনাবাদি এবং বাড়ির আশেপাশে পড়ে থাকা খালি জমিতে কী ধরনের গাছ কী পরিচর্যায় বেড়ে উঠতে পারে তা তাদের জানানো হয়। আগ্রহীরা কার্ড করেন, এডাপটেশন ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানে অনাবাদি জমিতে চাষাবাদ করে হাতেকলমে শেখেন। এই সেবার মেয়াদ ২ বছর। প্রথম বছর বীজ, সার, মাঠে নিয়মিত প্রশিক্ষণসহ সবধরনের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হয়, দ্বিতীয় বছর শুধু ফলোআপ ও পরামর্শ। এরপর তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে চাষাবাদ করবেন। তারপরও যদি কোনোকিছু জনার দরকার হয় তাহলে এডাপটেশন ক্লিনিক বা ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিক তো রয়েছেই।

ব্র্যাক এডাপটেশন ক্লিনিকে এসে ফসলের রোগ ও বালাইনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ নিচ্ছেন চাষিরা

এডাপটেশন ক্লিনিক জমি ও আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে চাষাবাদের গুরুত্ব দেয়। যেমন, যেখানে বেশি বন্যা হয় সেখানকার জন্য বন্যাসহিষ্ণু ধানের বীজ দেয়। এই ধান সপ্তাহখানেক বন্যার পানির নিচে থাকলেও ফলন পাওয়া যায়। খরাপ্রবণ এলাকায় দেওয়া হয় খরাসহিষ্ণু ধানের বীজ, যেগুলো ফলানোর জন্য সেচ কম দিতে হয়। আর সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার চাষিদের দেওয়া হয় লবণসহিষ্ণু বীজ যাতে সেগুলো নোনা পানিতেও টিকে থাকতে পারে।

দুজন অভিজ্ঞ কৃষক, গ্রামের প্রধান ও ব্র্যাককর্মীদের সমন্বয়ে একটি অ্যাডভাইজরি কমিটি করে ক্লিনিক। কমিটির লোকেদের সঙ্গে কৃষকদের থাকে নিবিড় যোগাযোগ। যেকোনো কৃষি বিষয়ক সমস্যা সমাধানে কৃষকের পাশে তারাও থাকেন। ফলে কাজ সহজ হয়, কৃষক ভরসা পান, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এর পাশাপাশি ব্র্যাককর্মীরা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা হবে কি না বা প্রতিদিনের আবহাওয়ার খবর আগে থেকে কৃষকদের জানিয়ে দেয়। সময়ের খবর সময়ে জানার কারণে ফসল বিনষ্ট বা অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় কম।

ফসল বিক্রি করে ভালো দাম না পেলে কি হয়! ব্র্যাকের এডাপটেশন ক্লিনিক জামালপুরে করেছে ‘এগ্রি স্টোরেজ’। এরকম আরও করা হবে যেন শস্য সংরক্ষণ করতে পারে কৃষক। এতে আর তাড়াহুড়ো করে কম দামে ফসল বিক্রি করতে হবে না।

শুরু করেছি জাহানারার সমস্যার গল্প দিয়ে, শেষ করতে চাই তার সমাধানের কথা দিয়ে। কৃষি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করে জাহানারার মরিচগাছের রোগ সেরেছিল। খুশি মনে তিনি বলেন, “এইয়ার আগে গাছের কোনো সমিস্যা হইলে কী করমু হেইয়া জানতে আমাগো ঘর থেকে এক্কেরে দূরে জেলা শহরে যাওয়া লাগতো। ওইডা ম্যালা কষ্টের আছিল। আর এহন ব্র্যাকের ডাক্তারসাব নিজেই আমাগো বাড়ির কাছে আইয়া পড়ছে। এইয়ার লাইগ্যা এহন আমাগো গিরামের হগল কৃষকের ম্যালা উপকার হইবো। হেগো অফিসও আমাগো গেরামের লগেই। ডাক্তারসাবের টোটকাতে কাম হওনের পরে আমি হেগো অফিসে গেছিলাম। যাইয়া দেহি আমাগো গেরামের আরও অনেকে ওইহানে বইয়া রইছে। ক্যামনে চাষ করমু, কখন ফসল কাটমু, কতডু সার দিমু, এডি ম্যালা কিছু শিখাইয়াও দিলো আমাগো। প্রতিডা বৎসর বন্যায় আমাগো ফসল নষ্ট হয়। হেরা আমাগো এমন বীজ দিলো যেইডা বন্যায় নষ্ট হইবো না, আর ফলনও ভালা দিব।”

ভালো থাকুন জাহানারা, ভালো থাকুন প্রান্তিক কৃষক ভাই ও বোনেরা।

সবজি খেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত জাহানারা বেগম

 

সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা, সাব্বির আহমেদ ইমন

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Ayshs siddika
7 months ago

অসাধারণ উদ্যোগ।

Anik
Anik
7 months ago

Good initiative.

Last edited 7 months ago by Anik
Md Jahangir Alam
Md Jahangir Alam
7 months ago

Exilent work