নিজের বাড়ি আছে আমার স্মৃতিতে

December 12, 2023

গ্রাম থেকে শহরে আসার ফলে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি হারিয়ে গেছে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় গ্রামের মহিলারা একসঙ্গে একত্রিত হয়ে গান গাইত, গল্প শোনাত। শীতের বিকেলে আমরা ফসল কাটা উদযাপন করতে পিঠা তৈরি করতাম এবং তা চারপাশের সবাই মিলে একসঙ্গে খেতাম।

আমি ঘরের চালা খুঁজতে বের হয়ে খুঁজে পাই প্রতিবেশীর মৃতদেহ।

ধানক্ষেতজুড়ে, গর্তে ও পতিত গাছের নিচে সবখানেই মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

সেই রাতের স্মৃতি এখনও আমাকে তাড়া করে ফেরে। টানা আধাঘণ্টা দৌড়ানোর পর রাত ২টায় আমরা সাইক্লোন শেল্টারে পৌঁছাই। বাতাস এত প্রবল ছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল আমরা যে কেউই বাতাসের তোড়ে উড়ে যেতে পারি।

ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে প্রায় ১৫ হাজার লোক মারা গিয়েছিল এবং অনেকেই তাদের স্থায়ী আবাসস্থল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর কিছুক্ষণের জন্য বাতাসের তীব্রতা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রের ছোট জানালা দিয়ে উঁকি দিতে না দিতেই আবার বাতাস শুরু হলো। তখনকার বাতাস ছিল কিছুটা উষ্ণ, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শীতল এক শিহরণ বয়ে গেল।

সেই সময় আমি আমার প্রতিবেশীকে মারা যেতে দেখি।

মাঠে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং তাদের গরুগুলো ছিল। সেখানে আমার প্রতিবেশী সামনের দিকেই ছিল। সাইক্লোন শেল্টারে আসার জন্য তারা মাঠের মাঝখান দিয়ে ছুটে আসছিল। কিন্তু আমগাছের সারি পার হতে না হতেই হঠাৎ পৌরাণিক সামুদ্রিক দানবের মতো পাশের ৬ কিলোমিটার প্রশস্ত পায়রা নদী ফুলে ফেঁপে তাদের মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে উঠল! আম গাছে থাকা কাকগুলো কালো মেঘের কুণ্ডলী দেখে উড়ে পালালো।

ঢাকায় নিজের কাপড়ের দোকানে মিনারা

মাঠের মধ্য দিয়ে ঢেউ বয়ে গেল। চারদিকে শুধু পানি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমগাছ, মানুষ, গরু মুহূর্তেই সব ডুবে গেল।

আশ্রয়কেন্দ্রে কাটানো রাতটি ছিল এক দীর্ঘ অন্ধকারময় রাত। কেউ ঘুমায়নি। আমরা মাঠে গিয়ে আটকা পড়া মানুষদেরকে সহায়তা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঝড় আমাদেরকে তা করতে দেয়নি। সারারাত ধরে একটানা বাতাস আর বৃষ্টি আশ্রয়কেন্দ্রে আঘাত হানছিল। এমনকি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসীরাও বুঝতে পেরেছিল, এখন বাইরে বের হওয়া মানেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা।

সূর্য ওঠার সঙ্গেসঙ্গে বাতাসের বেগ কমে আসে এবং বৃষ্টির পানি গড়িয়ে আবার নদীতে ফিরে যায়। ঝড়ের পর মাঠটি একটি বধ্যভূমিতে পরিণত হয়, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পশুর মৃতদেহ।

বাড়ি ফিরে দেখলাম শূন্য ভিটা। সেখানে পড়েছিল শুধু আমার সেলাই মেশিন। ঘূর্ণিঝড়ও এই বহু পুরনো গলিত লোহার যন্ত্রটিকে ভাসিয়ে নিতে পারেনি। ঘূর্ণিঝড় আমাদের এক রুমের টিনের ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

আমি বের হলাম ঘরের সবচেয়ে মজবুত অংশ ঢেউতোলা টিনের চালা খুঁজতে। এবার নিয়ে জীবনে পঞ্চমবারের মতো ঘরের চালা খুঁজতে বের হলাম। এবারে আমাদের ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

সিডরের তাণ্ডব ছিল ভয়াবহ। কয়েক বছর আগে শেষবার যখন আমাদের বাড়িটি বিধ্বস্ত হয়, তখন নিজেই বাড়ি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করি। হোগলা পাতা দিয়ে ঘরের বেড়া দিয়েছিলাম। একটার পর একটা হোগলা পাতা সাজানোর পর সুন্দর একটি ডিজাইন তৈরি হয়েছিল, যেন হলুদ রঙের বর্গাকৃতির একটি নিখুঁত ছোট আশ্রয়। আমি তখন একটু আশার আলো দেখতে পেতাম। এবারে আর কোনো আশাই রইল না। আমি নতুন করে বাড়ি পুনর্নির্মাণের উদ্যম হারিয়ে ফেললাম। কারণ আবার কোনো ঝড়ে হয়তো সেটি ভেঙে পড়বে। ষষ্ঠবারের মতো ঝড় মোকাবিলার মনোবল আমার ছিল না।

ঘরের চালা খুঁজতে বের হয়ে আমি আমার প্রতিবেশীদের মরদেহ দেখতে পেলাম।

আমি শূন্য, বিধ্বস্ত বসতভিটায় ফিরে আসি। স্বামীর দিকে তাকাতেই তিনি আমাকে যা বললেন, সেটাই আমি ভাবছিলাম-‘আর নয়, অনেক হয়েছে। চলো সব ফেলে ঢাকায় যাই।’

ঝড়ের মধ্যে জীবন

আমার জন্ম পায়রা নদীর তীরে। আমার এক মামাতো ভাই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তার সবকিছু অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। কারণ আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। কারণ এক বছর পর আমার মা-বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন। তখন আমার বয়স ছিল ১৪।

আমার স্বামী জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ জমির মালিককে দেওয়ার পর বাকিটা আমরা রাখতাম। বেশিরভাগ সময় আমরা বিশ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেছি। বছরে দু’বার ধান এবং একবার সবজির (আলু) চাষ করেছি। তিনটি ফসলের যে কোনো একটির ফলন খারাপ হলে সে বছর আর আমাদের কোনো লাভ হতো না।

আমাদের প্রথম সন্তান স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতাম। তার স্কুলের ফি পরিশোধ করার জন্য আমাদেরকে বাড়তি কাজ করতে হতো। আমি আমার বোনের পুরনো পা-চালিত সেলাই মেশিন ধার নিয়েছিলাম এবং কীভাবে এটি চালাতে হয়, তা শিখে বাড়িতে বসেই সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। কোনো কোনো দিন বেশ ভালোই আয় হতো আমার, দিনে ২শ টাকা। কিন্তু এরকম দিন খুব কমই আসত।

চাষের মাধ্যমে আয় কমে যাওয়ায় সেলাই কাজ জীবনধারণের অন্যতম ভরসা হয়ে ওঠে। খারাপ সময় পিছু ছাড়ছিল না আমাদের। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় ধানের ফসল নষ্ট করেছে, মরিচ মারাত্মক শীতের কবলে পড়েছে এবং মটরশুটি, বেগুন ও শসায় পোকার আক্রমণ।

এখন আমাদেরকে বলা হয় জলবায়ু অভিবাসী

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে আমি, আমার স্বামী এবং আমাদের তিন সন্তান বরগুনাকে বিদায় জানালাম। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া কাপড়চোপড়, কিছু জিনিসপত্র এবং আমার মরিচা পড়া সেলাই মেশিন ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যেখানে আগের দিন সমুদ্রের দানবটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, সেই নদীর দিকে আমরা শেষবারের মত তাকালাম। এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা ধার নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের পাঁচটি টিকিট কিনে ঘাটে চলে যাই।\

“আমি একবার সেলাই কাজ শুরু করার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। যে দোকান ভাড়া নেওয়ার জন্য দুই বছর ধরে সঞ্চয় করেছি, সেই দোকান ১৩ বছর ধরে চলছে।”-মিনারা

আমরা ঢাকায় কাউকে এবং কিছুই চিনতাম না। শহর সবসময় বিস্তৃতই ছিল। প্রতিটি গলিতে মানুষ। প্রতিটি রাস্তার ধারে কেউ না কেউ বসে ছিল। প্রতিটি দরজায় কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তার প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টে কেউ না কেউ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সর্বত্রই মানুষ এবং তাদের প্রত্যেকের কাছেই বিক্রি করার জন্য নানা ধরনের দ্রব্যসামগ্রী রয়েছে। টাকা নেই এমন একটি পরিবারের জন্য যা খুব প্রয়োজনীয় নয়। আমাদের মনের মধ্যে বরগুনার মাটি, গরু ও বৃষ্টির গন্ধ, আঁকাবাকা নদী এবং লম্বা  সারিবদ্ধ তাল গাছের একটি ছবি আঁকা ছিল। সেদিক থেকে ঢাকা শহর ধুলো, ঘাম, জ্বলন্ত প্লাস্টিকের গন্ধ, আবর্জনায় পরিপূর্ণ ড্রেন এবং মাথার ওপরে ঝুলন্ত ইন্টারনেটের তারে ভরা জঞ্জালে সজ্জিত।

ঢাকায় এসে পাঁচদিন দূরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। আমরা পাঁচজন ওই পরিবারের তিনজনের সঙ্গে এক বেডরুমে একত্রে ছিলাম। পাঁচদিন পর আমার স্বামী একজন রিকশার মালিককে তাকে রিক্সা চালানোর জন্য ভাড়া দিতে রাজি করান। প্রতিদিন মালিককে ২শ টাকা দিত এবং যদি কোনো  দুর্ঘটনা না ঘটে, তবে রোজগার খারাপ হতো না। কোনো ধরনের সমস্যা না থাকলে আমার স্বামী ৩শ টাকা রোজগার করে ঘরে ফিরতে পারত। যদি রিকশার কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে সমস্ত মেরামতের খরচ স্বামীকেই বহন করতে হতো। ছোট অলিগলিতে দুর্ঘটনা ঘটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। আমরা ৫০ বর্গফুটের একটি রুম ভাড়া নিয়েছিলাম এবং আমরা পাঁচজন এতে থাকতাম। আমি আবারও সেলাইয়ের কাজ শুরু করি এবং অপরিষ্কার ও ধুলোবালিময় রাস্তার পাশে তৈরি করা জামাকাপড় দেখানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখতাম। একটি দোকান ভাড়া করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সঞ্চয় করতে আমার দুই বছর লেগেছে। সেই দোকান এখন তেরো বছর ধরে চলছে।

মানুষ হয়তো ভাবে যে, আমি এখন ভালো আছি। আমার বড় ছেলে নিজের সংসার শুরু করেছে। আমার মেয়ে নার্স হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছে। কিন্তু আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না যে, আমার কেমন লাগছে।

গ্রাম থেকে শহরে আসার ফলে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি হারিয়ে গেছে। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় গ্রামের মহিলারা একসঙ্গে একত্রিত হয়ে গান গাইত, গল্প শোনাত। শীতের বিকেলে আমরা ফসল কাটা উদযাপন করতে পিঠা তৈরি করতাম এবং তা চারপাশের সবাই মিলে একসঙ্গে খেতাম। সেসব মুহূর্ত খুব মনে পড়ে। আমি বেঁচে গেছি, কিন্তু হারিয়েছি জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো, যা বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস যে, আমার মেয়ে নার্সিং পড়ার জন্য বর্তমানে বরগুনার পাশের জেলা  পটুয়াখালীতে রয়েছে। ঢাকায় পড়ালেখার ব্যয় বহন করতে না পারার কারণে তাকে সেখানে পাঠাতে হয়েছে। এটা খুবই পরিহাসমূলক যে, অর্থের অভাব ও জীবিকার জন্য না আমি উপকূলীয় অঞ্চলে থাকতে পারলাম, না আমার সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারলাম!

এখন যদি নিজের জন্য কিছু চাওয়ার থাকে তবে তা হলো আমার নিজের গ্রামে ফিরে বাকি দিনগুলো পরিচিতজনদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, দুঃখের গান গাওয়া এবং সিডরের স্মৃতি ভুলে যাওয়া। কিন্তু আমি সেই জীবনে ফেরত যাওয়ার জন্য কখনই পর্যাপ্ত আয় ও সঞ্চয় করতে পারি নি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। চারটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় প্রতি বছর বাংলাদেশে আঘাত হানে, যার ফলে প্রতি বছর ১শ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়, যা প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের এক মাসের আয়। ইতিমধ্যেই প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মানুষ ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হওয়ার পরিমাণ এবং তীব্রতা উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

মিনারা বেগম ঢাকায় বসবাস করেন এবং সেলাইয়ের কাজ করেন।

 

অনুবাদ : নিলয় তরফদার তপু, ইকরামুল কবীর

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments