আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধ নারীপুরুষ উভয়েরই ক্ষতিসাধন করে। পিতৃতন্ত্র থেকে উদ্ভূত পুরুষের কর্তৃত্ববাদী আচরণ নারীকে পদেপদে বাধাগ্রস্ত করে, একইসঙ্গে পুরুষের ব্যক্তিত্বের সঠিক ও ইতিবাচক বিকাশকে ব্যাহত করে। এভাবে পিতৃতন্ত্র নারীপুরুষ উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আগামী ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও যথানিয়মে এ দিবসটি আমাদের কাছে কিছু বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। এ বছর দিবসটিকে কেন্দ্র করে যে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি হচ্ছে ‘বদলে দেবার সময় এখন গ্রাম-শহরের নারীর জীবন।’
নারীর জীবনকে বদলে দেবার কাজটি বেশ দীর্ঘ একটি কাজ, মূল্যবোধগত ও আচরণগত অনেকগুলো বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান প্রতিপক্ষ পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধ নারীপুরুষ উভয়েরই ক্ষতিসাধন করে। পিতৃতন্ত্র থেকে উদ্ভুত পুরুষের কর্তৃত্ববাদী আচরণ নারীকে পদেপদে বাধাগ্রস্ত করে, একইসঙ্গে পুরুষের ব্যক্তিত্বের সঠিক ও ইতিবাচক বিকাশকে ব্যাহত করে। এভাবে পিতৃতন্ত্র নারীপুরুষ উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। ন্যায়বিচারসম্পন্ন সুষ্ঠ ও সুন্দর সমাজ গড়বার পথে এ এক বড়ো অন্তরায়। এই অন্তরায়কে দূর করতে হলে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নারীপুরুষ উভয়কেই সমানভাবে যুক্ত হতে হবে। একটি জিনিস খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে পিতৃতন্ত্র শুধু নারীর শত্রু নয় পুরুষেরও শত্রু। পিতৃতন্ত্র থেকে নারীকে যেমন, তেমনি পুরুষকেও বাঁচাতে হবে। পিতৃতন্ত্রকে পরাভূত করতে পারলে তাতে নারীপুরুষ উভয়েরই কল্যাণ হবে।
আপনাদের হয়তো মনে পড়বে, নারীপুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় আমি আমাদের অসম্পন্ন প্রচেষ্টার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম। বলেছিলাম,‘ আমার জীবনকালে নারীপুরুষের সমতা আমি দেখে যেতে পারব কি না জানি না। এটি হয়তো আমার জীবনের একটি অসমাপ্ত এজেন্ডা হিসেবে থেকে যাবে।’ আমি আরও বলেছিলাম, ‘সমাজের উন্নয়নের জন্য এবং পরিবারের সুখশান্তির জন্য নারীপুরুষের সমতার খুব প্রয়োজন। আমরা যারা ব্র্যাকে আছি, তারা যেন নারীপুরুষের সমতাকে আমাদের প্রথম অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করি।’
এবারকার ৮ই মার্চে এই কথাটার ওপর আমি আবার গুরুত্ব দিতে চাই। নারীপুরুষ সমতা হবে আমাদের প্রথম অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ব্র্যাক কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, আমাদের কর্মসূচিগুলোতে কীভাবে সমতা প্রতিষ্ঠার ইস্যুটিকে যুক্ত করা যায়, সে সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আমরা কিছু কাজ করছি, এখন আরও অগ্রসর হয়ে সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমাদের কর্মসূচিগুলোকে নতুন আঙ্গিকে বিন্যস্ত করতে হবে। যা কিছু নারী উন্নয়নের প্রতিবন্ধক, যা কিছু নারীকে পশ্চাদ্বর্তী করে রাখে, যা কিছু তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখে, যা কিছু তার মূল্য ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে ব্র্যাকে আমরা তার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব। নারীলাঞ্ছনার যে কোনো ঘটনায় শূন্য সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে আমরা সর্বত্র নারীর মর্যাদা সমুন্নত রাখব। সেইসঙ্গে মনে রাখব, নারীদের সমান সুযোগ দান শুধু মানবিক কর্তব্য নয়, সমাজের সঠিক উন্নয়নের জন্য নারীর বঞ্চনা ও নিপীড়নের অবসান হওয়া প্রয়োজন।
বিশ্ব জুড়ে নারীর বিরুদ্ধে যে অন্যায়, বঞ্চনা ও সহিংসতা ঘটে চলেছে, তার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া উপায় নেই। নারীপুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে পৃথিবীর কয়েকটি মাত্র দেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য প্রদর্শন করেছে। তারা সমতার অনেকটা কাছাকাছি এসেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রয়াস একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আর্থসামাজিক নানা ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। উন্নয়নের নানা সূচকে আমাদের আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু নারীর মর্যাদা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। এই অবস্থার অবসান ঘটাতেই হবে। কোনোরকম নমনীয়তা না দেখিয়ে সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
নারীপুরুষ সমতা শোষণমুক্ত ও ন্যায়বিচারসম্পন্ন সমাজ গড়ার অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। সুতরাং এই ক্ষেত্রটিতে আমাদের সাফল্য অর্জন করতেই হবে।