ব্র্যাকের কর্মীরা পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মায়েদের খাবার স্যালাইন বানানো শেখানোর কাজ করেন। এই কর্মীবাহিনীর বড়ো অংশই ছিলেন নারী।
সারা বিশ্বে বাংলাদেশ ‘উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রমের সূতিকাগার’ হিসেবে পরিচিত। সুপেয় পানি পানের প্রচলন থেকে শুরু করে বাল্যবিয়ে রোধসহ এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারের সহযোগী হিসেবে উন্নয়ন সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের এই সাফল্যে নারীকর্মীদের বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছে তাদের রয়েছে অসামান্য অবদান।
এমন একটা সময় ছিল যখন এই দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ডায়রিয়ায় মারা যেত। ঘরোয়া পদ্ধতিতে স্যালাইন বানানোর পদ্ধতির প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে ডায়রিয়াজনিত কারণে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ১৯৮০ সালের কথা, দেশের রাস্তাঘাটের অবস্থা তখন তেমন ভালো ছিল না। সেসময় ব্র্যাকের কর্মীরা পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মায়েদের খাবার স্যালাইন বানানো শেখানোর কাজ করেন। এই কর্মীবাহিনীর বড়ো অংশই ছিলেন নারী। স্যালাইন তৈরি শেখানোর জন্য পথে-প্রান্তরে নারীদের সেই পদচারণা সেসময়কার রক্ষণশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে ছিল অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিন্তু সকল বাধাকে অতিক্রম করে পরবর্তী কয়েক বছরে লক্ষ লক্ষ মাকে স্যালাইন বানানো শেখান ব্র্যাকের নারীকর্মীরা।
সেই সময় থেকে এখনও নারীকর্মীরা উন্নয়নসংস্থার প্রাণ। কেননা নারীদের মধ্যে মানবিক গুণাবলি অনেক বেশি মাত্রায় প্রকাশিত। তারা অন্যের দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে মনে করেন। দরিদ্র মানুষের প্রতি তাদের রয়েছে সহজাত মমত্ববোধ। তারা যে উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন সেই সংস্থার সেবাগুলো তারা নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাগুলোতে নারীকর্মীর সংখ্যা এখনও অনেক কম। এর অন্যতম কারণ সামাজিক বাধা। ‘উন্নয়ন সংস্থা বাড়ির মেয়েদের ঘর থেকে বের করে আনে। তারপর সেই মেয়েরা গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ায়, সাইকেল চালায়, বাড়ির বউদের স্বামীর অবাধ্য হতে উৎসাহ দেয়- এরকম বহু অপবাদ বছরের পর বছর উন্নয়ন সংস্থার নারীকর্মীদের সইতে হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে আমার একজন নারী উন্নয়নকর্মীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর ভাগ্যের ফেরে তিনি একে একে পিতামাতা, শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীকে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে হারান। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে তার সংসার। গ্রামের দরিদ্র নারীদের প্রতি তার মমত্ববোধ, অসামান্য ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি তাদের সকল সমস্যায় পরামর্শদাতা ছিলেন। নিজে ছোটো একটি চাকরি করলেও নির্দ্বিধায় গ্রামের দরিদ্র নারীর সন্তানের এসএসসি পরীক্ষার ফি দিয়ে দিয়েছেন। গ্রামের ধনী লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। কাজের প্রয়োজনে এই কর্মী অনেকবার কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু তিনি যেসব পরিবারের জন্য কাজ করেছেন, তারা এখনও ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিজের আপনজনদের হারিয়ে এই নারী গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষদের আপন করে নিয়েছেন। তাদের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
এটা সত্য যে, উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করা অত্যন্ত শ্রমসাধ্য। সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হয়। অনেক সময় পরিবার ছেড়ে অন্য এলাকায় একা থাকতে হয়। আবার পরিবারের সঙ্গে থাকলেও কাজের প্রয়োজনে কখনও কখনও অন্য এলাকায় রাতে অবস্থান করতে হয়। সেইসঙ্গে গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের মন্দ কথা তো অবিরত শুনতেই হয়। যত উচ্চ পদে পদোন্নতি হবে ততবেশি দায়িত্ব নিতে হবে এটিও নারীদের জন্য অনেক সময় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়। তারপরও সব বাধা পেরিয়ে নারীরা উন্নয়ন সেক্টরে কাজ করছেন। তারা সংখ্যায় নগণ্য কিন্তু অবদানের দিক থেকে মানবতার সেবায় অসাধারণ উদাহরণ তৈরি করেছেন।
আরেকজন নারীকর্মীর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলি। তিনি তখন অবিবাহিত ছিলেন। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতেন। একদিন তিনি কাজের প্রয়োজনেই সন্ধ্যায় একজন অতিদরিদ্র নারীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ দরজায় জোরে ধাক্কা দেওয়ার শব্দে তারা দুজনেই চমকে উঠলেন। কিছু বোঝার আগেই একজন অপরিচিত পুরুষ ঘরে ঢুকে পড়ে। গালিগালাজ করতে করতে মদ্যপ সেই লোকটি সোজা নারীকর্মীটির দিকে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। প্রচন্ড আতঙ্কে দিশেহারা ওই নারী নিজেও জানেন না কীভাবে তিনি ওই লোকের আগ্রাসি হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রচন্ডভাবে ট্রমাটাইজ ঐ কর্মী পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েক মাস মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য তাকে কর্মএলাকা ছেড়ে পরিবারের কাছে চলে যেতে হয়েছিল। তার বাবা-মা চাননি তাদের আদরের কন্যা আর কখনও উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করুক। কিন্তু মনের ভয় কাটার পরে তিনি বাবা-মার নিষেধ অমান্য করেই কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেন। কেন ফিরে এসেছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, সেসময় নাকি তার মনে হয়েছিল, গ্রামের অসহায় নারীরা তার জন্য অপেক্ষায় বসে আছেন! সরাসরি মানুষের উপকার করতে পারার এই আনন্দ আর অন্য কোনো চাকরিতে পাওয়া সম্ভব নয়।
আমি বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকে কাজ করি। মাসে অন্তত একবার ঢাকার বাইরে যেতে হয়। প্রায়ই কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ করা হয়। সংসার-সন্তান সব সামলে চাকরি করাটা খুব সহজ নয়। তবু আমি এগিয়ে চলেছি। যখন গ্রামে যাই আর দেখি নারীকর্মীরা মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন, তারা আঞ্চলিক অফিসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন, বিশাল কর্মীবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তখন ভীষণ ভালো লাগে। অতিসাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা নারীদের কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার গল্প শুনলে নিজের জীবনের সমস্যাগুলোকে তুচ্ছ মনে হয়। তাদের প্রতি সম্মানে মাথা নুয়ে আসে।
প্রতিটি বেসরকারি সংস্থারই উচিত নারীকর্মীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিতে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া। নারীরা যেভাবে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে পারেন, দায়িত্ব পালনে তাদের যে একনিষ্ঠতা তা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। একইসঙ্গে উন্নয়ন সংস্থা যেহেতু সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাই গ্রামগঞ্জ বা মফস্বল শহরে বসবাসরত নারীদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরিতেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই শুধু প্রান্তিক নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ নয় বরং সেই কার্যক্রম পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব নিশ্চিত করাও হোক বাংলাদেশে কর্মরত উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
উপমা মাহবুব, ম্যানেজার গ্লোবাল লার্নিং অ্যান্ড কোলাবরেশন, আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন ইনিশিয়েটিভ, ব্র্যাক