হৈ হৈ কান্ড, রৈ রৈ ব্যাপার

November 9, 2017

এ কেমন কান্ড! ঘরটাকে ওরা যেন খেলার মাঠ বানিয়ে ফেলেছে! চারদিকে সবাই ছোটাছুটি করছে আর যার যেভাবে ইচ্ছে খেলছে, হাসছে, গাইছে!

চারপাশে কিছু কাগজ চোখে পড়ছে যেখানে কিছু না কিছু আঁকা- কোথাও রংধনু, আবার কোথাও হিজিবিজি! এই হিজিবিজির গোপন অর্থ শুধুমাত্র যিনি এঁকেছেন তিনিই জানেন! ছড়া আর পুরনো গানের আওয়াজে কান পাতা দায়। এই গোলমালের ভেতর কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও আছেন, সবকিছু সামলাতে তার অবস্থা পাগলপ্রায়!

এই গোলমালের কিন্তু একটি ধরণ, প্রক্রিয়া এবং উদ্দেশ্য আছে।

ওরা এখানে পুরো পৃথিবীকে শাসন করছে যেন, আপন জগতে নিজেদের খেলার মাধ্যমে। প্রতিটি রং যা দিয়ে তারা রাঙ্গিয়ে তুলছে আঁকার খাতা, প্রতিটি খেলনা যা দিয়ে তারা খেলছে, প্রতিদিন পাওয়া প্রতিটি নতুন বন্ধু যাদের সাথে তারা খেলছে- এসব কিছুই তাদের শেখার সামর্থ্য এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে।

যে ভীষণ গোলমালের দৃশ্য আমরা উপরে দেখতে পেলাম তা রাজধানী ঢাকার অদূরবর্তী সাভারে শিশুদের জন্য নির্মিত এবং পরিচালিত ‘খেলার জগত’-এর নিত্যদিনকার ঘটনা।

এই খেলার জগতে আসে এক মাস বয়সী শিশু থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু। খেলতে খেলতে তাদের কতকিছুই না শেখানো হয়! শিশুদের দেখভালের জন্য সেখানে রয়েছেন একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি। প্রায় প্রত্যহই কয়েকজন শিশুর মা নিজেরাই সেখানে থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শিশুদের দেখাশোনা করেন। তারা গান গায়, ছুটে বেড়ায়, যার যার বয়স উপযোগী খেলনা দিয়ে খেলে এবং ঘুম পেলে যত্নের সাথে তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়।

আদর পাওয়ার সময়, একই সাথে শেখারও সময়

জন্মের পর প্রথম কয়েকটি বছর প্রত্যেক শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। এই সময়ে চারপাশে নতুন অনেক কিছুর সাথে তাদের পরিচয় ঘটে, তাদের শেখার সামর্থ্যের উপর যা প্রভাব ফেলে। শিশুদের বয়স তিন বছর হতে হতে তাদের মস্তিষ্কের প্রায় ৮০% বিকাশ ঘটতে থাকে।

শিশু মনোবিশেষজ্ঞগণ বরাবরই প্রাক-শৈশব উন্নয়নের ক্ষেত্রে খেলাধূলার ব্যাপারটির উপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে আসছেন। শিশু মনোবিশেষজ্ঞ গ্যারি ল্যান্ড্রেন্থ এবং লিন্ডা হোমায়ের এর মতে, “একটি শিশু এখন কেমন, বা সে কি করতে চায় বা সময়ের সাথে সাথে তার বিকাশ সবই খেলাধুলার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব।”

উন্নয়নশীল দেশে প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে একজন তার অভিভাবকদের সাথে পড়াশোনা, খেলাধূলা বা গান ইত্যাদি চর্চা থেকে বঞ্চিত। অথচ এই সহজ সরল কর্মকান্ডগুলো কিন্তু শিশুদের জ্ঞান বৃদ্ধি, সামাজিক এবং মানসিক বিকাশ, এমনকি নিজেদের পছন্দ অপছন্দ বেছে নিতেও সহায়তা করে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি ৪) অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সকল শিশু যেন প্রাক-শৈশব উন্নয়নের সুযোগ পায়। এছাড়াও আদর-যত্নের পাশাপাশি তাদের মধ্যে যেন প্রাক-শৈশব শিক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের উপযোগী মনন গড়ে তোলা হয়।

শিক্ষায় সাম্যতা এবং ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি চমকপ্রদ এবং বিস্ময়কর। অবশ্য, আমরা শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করতে পারলেও তাদের জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে যথেষ্ট মনোযোগ প্রদান করিনি। এর ফলে একটি পর্যায়ে গিয়ে তাদের শিক্ষা অর্জনের সামর্থ্য বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে- পরীক্ষায় তাদের ফলাফল খারাপ হচ্ছে, একই ক্লাসে একাধিকবার পড়তে হচ্ছে এবং অনেকেই স্কুল থেকে পরবর্তী সময়ে ঝরে পড়ছে।

সকলের সাথে মিশতে মিশতেই সন্তান বেড়ে ওঠে

আমাদের দেশে অনেক নিম্নআয়ের পরিবারেই বাবা-মায়েরা তাদের ঘরের কাজ বা জীবিকা নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেন। যার ফলে তাদের শিশু সন্তানের সাথে অনেক সময়ই তাদের খেলা বা রাতে ঘুমানোর সময় তাদের গল্প শোনানো কিংবা গান গাওয়া ইত্যাদি কিছুই হয়ে ওঠে না। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তারা তাদের সন্তানদের সাথে পর্যাপ্ত এবং গুনগত সময় কাটানোর সুযোগটুকুও পাননা।

‘খেলার জগত’ বাচ্চাদের বাবা-মাকে একটু ভিন্ন আলোকে তাদের শিশু-সন্তানদের খেলাধূলার বিষয়টিতে সামষ্ঠিকভাবে মনোযোগী হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী করে। প্রাক-শৈশব উন্নয়নের গুরুত্বটি তাদের বুঝিয়ে এই কার্যক্রমে রাজি করানোর বিষয়টি ছিল একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।

এর উত্তর প্রত্যেক অভিভাবকই পেয়েছেন। প্রত্যেক অভিভাবকই এখন অনুধাবন করতে পারছেন এই উদ্যোগের ফলাফল। তাঁরা তাদের সন্তানদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন বিশেষ কিছু পরিবর্তন- সেটা শুধু ঘরে নয়, স্কুলে যাবার ক্ষেত্রেও। পরিবর্তনগুলো অবশ্যই ইতিবাচক।

“আমাদের সন্তানদের মধ্যে যারা খেলার জগতে গেছে তারা স্কুলেও খুব ভালোভাবে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে।”- এভাবেই ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন চার বছর বয়সী এক সন্তানের মা।

“প্রাথমিক স্কুলে যে ছড়া এবং গানগুলো সেখানে হয় সেটাতো বাচ্চারা খেলার জগতেই শিখে এসেছে। তাদের কাছে স্কুলের পড়াশোনা যেমন সহজ মনে হয়, তেমনি নতুন বন্ধুদের সাথে মেশাটাও এখন তাদের কাছে অনেক সহজ।”

তাঁর মতে শিশুরা এখন আগের চেয়ে আরও বেশি কথা বলার চেষ্টা করে, নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করে- আগের চেয়ে অনেক স্পষ্টভাবে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে।

শুধুমাত্র শিশুদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে বলেই অভিভাবকগণ বা খেলার জগতের দায়িত্বপ্রাপ্তরা খুশি, তা কিন্তু নয়। খেলার জগতে প্রতি মাসে একটি মিটিং বা মিলনমেলা আয়োজন করা হয় যেখানে বড়রাও খেলার সুযোগ পান! স্থানীয় মানুষজন এখানে একত্র হয়ে একে অপরের সাথে কথা বলার সুযোগ পান, যার ফলে নিজেদের পরিবার এবং শিশুদের মধ্যে বন্ধনও হচ্ছে দৃঢ়।

অভিভাবকরা ইদানিং নিজেরাই তাদের সন্তানদের জন্য খেলনা তৈরি করছেন। তাদের বেশি কিছু লাগছে না, মাটি হলেই যথেষ্ট! হাতে তৈরি মাটির খেলনা তাঁরা তৈরি করছেন, যার মধ্যে পুতুল যেমন আছে, আবার নানারকমের ব্লকও আছে। আছে মাছ, পাখি- হাতে বানিয়ে এগুলো রোদে শুকাতে দেয়া হয়। কখনও বা মাটির পাশাপাশি বাঁশ, এমনকি প্লাস্টিকের বোতলের ক্যাপ ব্যবহার করেও খেলনাগুলো বানানো হয়ে থাকে- যা ব্যয়সাশ্রয়ীও বটে।

আমাদের এই পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ড চারজন করে নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করে। এই ক্ষুদে, নতুন অভিযাত্রীদের প্রত্যেকেরই অধিকার আছে যে অপার সম্ভাবনা নিয়ে তারা পৃথিবীতে এসেছে তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ঘটানোর।

দুইশ’র কিছু অধিক কেন্দ্র নিয়ে শুরু হয়েছিল এই ব্যতিক্রমী যাত্রা। এখন পর্যন্ত এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজারে। এই কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার শিশুর কাছে আমাদের সেবা পৌঁছাতে পেরেছি। এই অতিথিরা ভূমিষ্ঠ হবার আগেই কিন্তু তাদের নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়!

আমাদের নিবেদিতপ্রাণ স্বাস্থ্যসেবিকাগণ দেশের আনাচে কানাচে সন্তানসম্ভবা মা’দের কাছে পৌঁছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তারা সন্তানদের প্রাক-শৈশব উন্নয়ন বিষয়ে মাকে পরামর্শ দেন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর জরুরি করণীয় বিষয়সমূহ সম্পর্কেও অভিভাবকগণকে সচেতন করে তোলেন।

ব্র্যাকের ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচির মাধ্যমে এদেশে প্রথম শিশুদের প্রাক-শৈশব উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। এর মাধ্যমে দেশের অনেক শিক্ষাবীদ এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা এই কর্মসূচিতে কাজে লাগাবার সুযোগ পান।

শিশুরা দুষ্টামি করবেই। ঘরজুড়ে তাদের বিচিত্র কর্মকান্ড সৃষ্টি করবে বিচিত্র ধরণের গোলযোগ এবং গোলমালের। এই হইহুল্লোড়, হইচই-এর মাধ্যমেই কিন্তু শিশুদের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাচ্ছে এখানেই। প্রাক-শৈশব উন্নয়নের উপর আরও গুরুত্ব প্রদান করা হোক, কেননা শৈশব ছাড়িয়ে তারা যখন আরও বড় হবে, তাদের খেলার জগত হবে আরও অনেক বিশাল, অনেক সম্ভাবনাময়!

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments